রীনা পারভীন মিমি
বাবা ও স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার নেই কথাটির কোন ভিত্তি নেই। বাবা ও মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের কথা স্পষ্ট বলা আছে আইনে। অথচ অনেকে এ ব্যাপারে এখনও অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে নারীদের। অন্ধকারে না থেকে জাগ্রত হবার সময় এসেছে, সময় এসেছে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার।
নারীর কোয়ান্টিটি টাইম অনেক আছে, কিন্তু কোয়ালিটি টাইম একটুও নেই। মনের মধ্যে জমে থাকা সব দুর্বলতা, হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইলে মজবুত হওয়া দরকার পায়ের নীচের জমি। আর তার জন্য প্রতিটি মেয়েকে প্রথমেই বুঝে নিতে হবে নিজের আর্থিক অধিকারগুলো। তা সে বাবার সম্পত্তিতেই হোক কিংবা স্বামীর। বাংলাদেশের আইনে সে সব পরিষ্কার ভাবে বলা রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ নারীরাই তার খবর রাখেন না। প্রত্যন্ত গ্রাম ও শহরতলি তো বটেই, শহরেও সমাজের বড় অংশে এই সচেতনতার বড্ড অভাব। এমনকী বহু শিক্ষিত পরিবারেও একই ছবি।
তাই সমস্যায় পড়লে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। নিজের অধিকার আদায় করতে কেউ কেউ সাহস করে এগুলেও আর শেষ দেখতে পারেনা । হার মেনে নিয়ে সরে আসেন। আইন কিন্তু বলছে, বিয়ে হোক বা না-হোক বাবা ও মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মেয়েরা। স্বামীর কাছেও স্ত্রীর অনেক আধিকার ভোগ করে থাকেন।
এই লেখাটি, মেয়েদের জন্যই মেয়েদের সচেতন করা। কারণ, তাঁদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম।
কোথাও সন্তান-সহ তরুণী মা লড়ছেন স্বামী-শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে, কোথাও স্বামীহারা স্ত্রী লড়ছেন মাথার উপরে একটু ছাদের জন্য। কোথাও আবার ভাইদের বঞ্চনায় সব খোয়ানো একা সে পথচলা। অবিবাহিত মেয়ে খড়কুটো ধরতে মরিয়া। নিজের আর্থিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে তবেই না প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বেঁচে থাকার যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া যাবে!
উত্তরাধিকার অনুযায়ী ৩ শ্রেণীর মেয়েরা চিরকালই ভাগিদার; এরা হলেনঃ মা, স্ত্রী ও কন্যা। কোন অবস্থাতেই এদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না । তাদের অংশ হারায় না ও নষ্ট হয় না।
মৃত ব্যক্তি সন্তান রেখে মারা গেলে মায়ের অংশ হবে ১/৬ আর মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে ১/৩ ভাগ পাবে ।
বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারঃ
কন্যা সন্তানের অংশ : উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কন্যারা তিনভাবে মাতাপিতার সম্পত্তি পেতে পারে। একমাত্র কন্যা হলে তিনি রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ বা (১/২) অংশ পাবে। একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাগে তিন ভাগের দুই ভাগ বা (২/৩) অংশ পাবে। যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে। যাহোক কন্যা কখনো মাতাপিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না।
তবে বাবা যদি উইল করে মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন, তা হলেও আপত্তি জানানোর অধিকার থাকে তাঁর। যাঁর বা যাঁদের অনুকূলে ওই উইল করা হয়েছে, অধিকার বুঝে নিতে বাবার মৃত্যুর পরে তাঁকে বা তাঁদের প্রোবেট নিতে হয়। আইন অনুযায়ী প্রোবেট নেওয়ার সময়ে নির্দিষ্ট এলাকার বা ‘জুরিসডিকশন’-এর আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। এবং এর জন্য সমস্ত ভাই বোনেদের বা বাকি সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের আইনি নোটিশ পাঠানো বাধ্যতামূলক। সেই সময়ে বঞ্চিত মেয়ে ওই নির্দিষ্ট আদালতে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়ে উইলটির বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করতে পারেন। জানাতে পারেন নিজের যুক্তি।
নাবালিকা হোন বা সাবালিকা, যত দিন না বিয়ে হচ্ছে, সাধারণত তত দিন মেয়েরা বাবার কাছ থেকে খোরপোষ পাওয়ার অধিকারী।
বিবাহিত জীবনে মেয়েদের অধিকারঃ
বিয়ের পরে মেয়েদের ঘর পাল্টায়, পাল্টে যায় চেনা চারপাশ পরিচিতি। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া সকল কিছু ছেঁড়ে নতুন কিছুকে বরণ করে নিতে হওয়াটাই নারীদের জীবনের একদিন পরীক্ষা। বিয়ের পর স্ত্রীকে বোঝা ভাবছেন, সমাজে এমন পুরুষের সংখ্যা কম নয়। আর সেই বিবাহিত জীবনে বহু মেয়েই অত্যাচারিত হয়েও মুখ বুজে পড়ে পড়ে মার খান শুধুমাত্র নিজের অধিকার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নন বলে।
ম্যারেজ রেজিস্টারে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সিলমোহর পড়ার মুহূর্তেই পাকা হয়ে যায় পত্নী হিসেবে মেয়েটির আর্থিক অধিকারগুলি। বিবাহ শব্দের মানে ‘বিশেষ ভাবে বহন করা’। তাই বিয়ের পর স্বামীর পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণের।
বিয়ের পরে একটি মেয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠবে এবং সেখানেই তার অধিকার গড়ে উঠবে। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই রীতিই এখন মেয়েদের আইনি অধিকার। তাঁকে ওই বাড়ি থেকে বেআইনি ভাবে কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে না।
স্ত্রীর ভরণপোষণের ক্ষেত্র ‘বিবাহিত অবস্থায় একসাথে থাকা, আলাদা থাকা বা তালাকের পর’ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। বিয়ের ফলে কিছু আইনগত অধিকার ও দায়িত্ব সৃষ্টি হয়।
যেমন-একত্রে থাকার অধিকার, দেনমোহরের অধিকার, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর মতামতকে সম্মান প্রদর্শন, স্বামী স্ত্রী পরস্পরের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাবার অধিকার, ভরণপোষণের অধিকার। ভরণপোষণ স্বামীর দায়িত্ব ও স্ত্রীর অধিকার। তাই আইন অনুযায়ী এটা ধরেই নেয়া হয় যে, স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন। ভরণপোষণ প্রদানের পর্যায়সমূহ হল- (১) বিবাহিত অবস্থায় ভরণপোষণ (২) বিবাহিত কিন্তু পৃথক থাকা অবস্থায় ভরণপোষণ (৩) বিয়ে-বিচ্ছেদের পর ভরণপোষণ।
এখন কথা হচ্ছে বিবাহিত অবস্থায় ভরণপোষণ কি ধরণের ?
বিয়ের সম্পর্ক থাকা অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন। তবে এর কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় নি। স্বামীর আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ভরণপোষণ দেবার ক্ষমতা নির্ভর করে।
স্বামীর সমস্ত রকম স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর সমান অধিকার। স্ত্রীর যদি নিজের রোজগার থাকে, তা-ও স্বামী তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণ বা খোরপোষ সংক্রান্ত দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। স্বামীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী থাকাটা স্ত্রীর অধিকার। আবার স্বামী যখন বিয়ে করে স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে আসছেন তখন নিজের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীকে সামাজিক নিরাপত্তা ও আর্থিক সুরক্ষা দেওয়াও স্বামীর কর্তব্য।
বিয়ে ভাঙলেঃ
এ ক্ষেত্রে আদালতের চোখে সকল মহিলার অধিকার কিন্তু এক রকমের না-ও হতে পারে। কারণ ঘটনা ও জীবন বিশেষে সকলের দাবি এক হয় না। একজন মহিলা স্বামীর বিরুদ্ধে কোন গ্রাউন্ডে আদালতে শরণাপন্ন হয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়; (তবে সাধারণ ভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত বা বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী যে-সব অধিকার পেতে পারেন, সেগুলি হল- বাপের বাড়িতে থাকলেও তাঁর ও সন্তানের ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন এবং পেতে পারেন খোরপোষ।
বিয়ের পরে স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারঃ
স্ত্রীর অংশ : স্ত্রীও ২ ভাবে তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তি পেয়ে থাকে। বিধবা স্ত্রী কোন ভাবে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা তাঁদের পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবে। যদি মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে তবে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবে। স্ত্রী একাধিক হলেও সবাই মিলে ১/৪ অংশ সমান ভাগেই পাবে।
শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা, বিবাহবিচ্ছিন্না ও বিধবা হলেঃ
ভাল চাকরি-বাকরি করলে হয়তো দেওয়ালে পুরোপুরি পিঠটা ঠেকে যায় না। কিন্তু অতি সামান্য রোজগার বা একেবারে সহায়-সম্বলহীন ভাবে যদি কেউ শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন এবং তার উপর সঙ্গে যদি সন্তান থাকে, তা হলে সেই মেয়ের দুর্দশা অন্তহীন।মনে রাখবেন- শ্বশুরবাড়িতে অশান্তির জেরে কোনও মহিলা বাপের বাড়িতে ফিরতে চাইলে, আইনি সহায়তায় তিনি ফিরতেই পারেন। স্বামী হারানো বিধবা মহিলার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। আগেই বলেছি, একজন বিবাহিতা মহিলার বিয়ের পরেও বাবার বাড়িতে পূর্ণ অধিকার থাকে। সুতরাং শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা, বিবাহবিচ্ছিন্না ও বিধবা— সকলেই বাবার সম্পত্তির সম্পূর্ণ হকদার। টাকা-পয়সা, জমি-বাড়ি, শেয়ার অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাই থাকুক না কেন, একক সন্তান হলে এবং মায়ের অবর্তমানে পুরোটাই দাবি করতে পারেন মেয়ে।
স্বামী মারা গেলেঃ
স্বামী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি ও বাপেরবাড়ি, দুই জায়গাতেই অনেক সময় ব্রাত্য হয়ে যান বহু মেয়ে। সমাজে নড়বড়ে হয়ে যায় তাঁদের অবস্থান। অথচ বিধবা মেয়ের বাপেরবাড়িতেও যেমন অধিকার থাকে, তেমনই তাঁর প্রাপ্য অধিকার অস্বীকার করতে পারে না শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও।
স্বামীর মৃত্যুর পরে তাঁর বিধবাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বেআইনি। আইন অনুযায়ী, বিধবা মহিলারা শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে ভরণপোষণ পেতে পারেন।
পরলোকগত স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার বর্তায় ঠিকই, তবে পুরোটাই তিনি পাবেন না। স্ত্রী-সহ সমস্ত আইনি উত্তরাধিকারী, যাঁরা জীবিত আছেন তাঁরা সকলেই ওই ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দাবিদার। অর্থাৎ বিধবা স্ত্রী পাবেন একটা সমান ভাগ।
মায়েদের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারঃ
মুসলিম সম্পত্তি আইন অনুযায়ী একজন মেয়ে ৩ নিয়মে মৃতের সম্পদ পেয়ে থাকে। যদি একজন মেয়ে হয় তবে দুইভাগের একভাগ (১/২) পাবে। যদি একাধিক মেয়ে হয় তবে সবাইকে তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩) দেয়া হবে। যদি মৃত ব্যক্তির ছেলে মেয়ে উভয়েই থাকে তবে ছেলে যে পরিমাণ পাবে মেয়ে তাঁর অর্ধেক পাবে।
লেখকঃ আইনজীবী।
Discussion about this post