মাসুদ উত্তরে বলল, “আরে হরতাল-অবরোধে তো প্রতিদিনই ২/৪টা বাস পোড়াইতাছে, খবর দেখছনা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে প্রতিদিনই কয়জন ভর্তি হইতেছে?”
তখন ঐ বন্ধু কিছুটা থেমে বলল, স্যাররা বলছে যদি একজনও ক্লাসে আসে তবে ক্লাস হবে এবং যে ক্লাস একবার হয়ে যাবে সেটার মেকআপ আর করানো হবে না। তখন, ঐ সিলেবাসেই পরীক্ষাও দিতে হবে। এখন তুই সিদ্ধান্ত নে, ক্লাস করবি কি করবি না। তাছাড়া, দুই-একটা বাস পুড়লে কি হয়েছে সারাদিনই তো ঢাকা শহরে গাড়ি চলছে। চলে আয়।
মাসুদ ভাবছে ঠিকই তো ক্লাস না করলে পরীক্ষা কিভাবে দিবে, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিটে দেরি হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় বাসা থেকে ফোন করল। বাসা থেকে এককথায় ক্লাস করতে নিষেধ করে দিয়েছে মাসুদের বাবা-মা। মাসুদ কিছুতেই তার বাবা-মাকে বুঝাতে পারছে না ক্লাস করা না করা সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। তারপরও টিভি-পত্রিকায় পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ব্যক্তিদের পোড়া শরীর দেখে মাসুদ সিদ্ধান্ত নিল যাই হোক সে এই অবরোধ-হরতালে ক্লাস করবে না। কিছুদিন এইভাবে কেটে গেল। মাসুদ তার বন্ধুদের সাথে ক্লাসের খোঁজখবর নিতে ফোন করলে সবাই তাকে ক্লাস সম্বন্ধে হতাশাজনক খবর দিচ্ছিল। বন্ধুরা জানালো, ক্লাস পুরোদমে না হলেও কিছু কিছু টিচারের ক্লাস নিয়মিত হচ্ছে। আর, সকল শিক্ষার্থীরা না আসলেও যারা ভার্সিটির হোস্টেলে আছে বা ভার্সিটির কাছাকাছি থাকে তারা সবাই নিয়মিত আসছে। তবে সব মিলিয়ে ৩০%এর মত শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। কিন্তু, টিচাররা বলেই দিয়েছে যারা আসবে না তাদের জন্য পুনরায় কোন ক্লাস নেওয়া হবে। এইবার,মাসুদ সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু ৭০% শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারছে না এই হরতাল-অবরোধে, তাহলে সেও আর ঝুঁকি নিবে না।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল এর এক সপ্তাহ পর। মাসুদের এক বন্ধু ফোন করে বলল,আগামীকাল থেকে ক্লাস টেস্ট শুরু হবে। একবারই নেওয়া হবে, এখন না দিলে আর সুযোগ থাকছে না। নিরুপায় হয়ে পড়ল মাসুদ। মাসুদ তখন ঐ বন্ধুদের অনুরোধ করল,পরীক্ষাগুলো না দেওয়া জন্য। তাদের কয়েকজনের উপস্থিতির জন্য বাকীদের যদি ক্লাস-পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তবে কীসের বন্ধুত্ব, কীসের মনুষ্যত্ব,কীসেরই বা গণতন্ত্র?
বন্ধুটা সব বুঝেও কেবল আমতা আমতা করে শিক্ষকদের ঘাড়ে সব দোষ ছাপালো। তখন মাসুদ দিশেহারা হয়ে, বন্ধু নামক ঐসব কতিপয় সহপাঠী আর কতিপয় শিক্ষকদের উপর নিজের রাগ-ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ক্লাসে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
পরদিন যথাসময়ে মাসুদ সব গুছিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অনেকদিন পর অনেকটা ভয় ভয় মনেই ভার্সিটিতে পথে মাসুদ। বাসায় জানিয়েছিল, সে ভার্সিটি যাবে না। বাসায় মিথ্যে বলে মাসুদ এখন লোকাল বাসে ছড়ে যাচ্ছে ভার্সিটিতে। সারা রাস্তায় একটু ভয় কাজ করছে কখন জানি তার বাসটিতেও পেট্রোল বোমা মারা হয়, না হয় ককটেল। জানালার পাশে বসেছে মাসুদ, জানালাও আটকানো মোটামুটি আটকানো। বাসে মোটামুটি কোন ঝামেলা হল না মাসুদের। নিরাপদেই বাস জার্নি শেষ করে ভার্সিটির কাছাকাছি গিয়ে নামল। এখন খানিকটা হেঁটে যাওয়ার পথ। রাস্তা পর হয়েই ভার্সিটি যেতে হবে মাসুদকে। মাসুদ গাড়িঘোড়া দেখে রাস্তা পার হচ্ছে, এমন সময় তার পাশ দিয়ে একটি বাস যাচ্ছে। বাস দেখে সে থেমে গেল, কিন্তু বাসটা তাকে ক্রস করে যাওয়া মাত্রই কিছু একটা সবকিছু অন্ধকার করে দিয়ে তার মাথায় এসে পড়ল। এরপর,মাসুদের আর কিছু মনে নাই।
হাসপাতালের বিছানায় মাসুদের এখনো জ্ঞান ফিরে নাই। মাসুদের পাশেই একরকম জ্ঞান হারিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে মাসুদের মা। আর বাবা তো শোকে পাথর হয়ে আছেন, মাসুদের মাকেও সান্তনা দেওয়ার মত শক্তি উনি হারিয়ে ফেলছেন। ডাক্তার এসে জানিয়ে গেলেন, মাসুদের চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গেছে। মাসুদ আর চোখে দেখতে পাবে না। আর মাসুদের চেহারার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন আপনার কাছে, আমার কাছে, জাতির কাছে প্রশ্ন আজ মাসুদের এই অবস্থার জন্য দায়ীকে? কে নিবে এই দায় ভার?
১। হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারী গোষ্ঠী?
হরতাল-অবরোধ ছাড়া তো বাংলাদেশে কখনো ককটেল ফুটে নাই, পেট্রোল বোমা মারা হয় নাই। হরতাল-অবরোধ মানেই হচ্ছে গাড়ি ভাংচুর, গাড়িতে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ, পেট্রোল বোমা। যেহেতু, হরতাল-অবরোধ হলেই কেবল এমন হয়, তার মানে হরতাল-অবরোধে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এই দায় ভার তো হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদেরই হবে। তাই নয় কি?
২। সরকার?
সরকারকে টেনে আনাটা অনেকেই আড় চোখে দেখবেন। কিন্তু, আমি বলতে চাই,যেই সরকারকে জনগণ ক্ষমতায় এনেছে সেই সরকার যদি জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণ কার দুয়ারে আশ্রয় নিবে??
তাছাড়া, পাবলিক পরীক্ষাগুলো হবে কি হবে না এইসব সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করে বলতে পারলে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কেন কোন নোটিশ নেই সরকারের?
৩। সন্ত্রাস?
শাহরুখ খানের একটা ছবি দেখেছিলাম, ‘মাই নেম ইজ খান’। ছবিতে একটা ম্যাসেজ থাকে এমন যে, ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাসই, তার কোন ধর্ম নেই’। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি বলব, ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাসই, তার কোন দল নেই, না আওয়ামী লীগ,না বিএনপি, না জামায়াত, না জাপা না অন্য কিছু। তারা সন্ত্রাস, এটাই তাদের দল’। টাকার বিনিময়ে কিংবা অন্য কিছুর মোহে তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।
৪। কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের?
হরতাল-অবরোধে ক্লাস বন্ধ রাখলে সরকারের চোখে শত্রু, পুরোদমে খোলা রাখলে সরকারবিরোধীদের চোখে। তাই, কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে ধরি মাচ না ছুঁই পানি স্টাইলে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। “শিক্ষার্থী আসলে ক্লাস হবে, না আসলে হবে না”- এটাই এখন তাদের স্টেটমেন্ট। আমার একটা প্রশ্ন, শিক্ষার্থী না আসলে দুনিয়ার কোন পাঠশালায় ক্লাস হয়েছে শুনি?
৫। কতিপয় শিক্ষক?
শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গঠনের কারিগর। তাই, যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধের সাথে প্রশ্নটা করছি, আপনারা গণতান্ত্রিক একটি দেশে কীভাবে ২জন শিক্ষার্থী আসলেও ক্লাস করান এবং তা পরবর্তীতে মেকআপের কোন সুযোগ থাকবে না?
আপনাদেরকে দেখে তো অনেকসময় মনে হয় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আপনারা থাকলে যুদ্ধে যেতে দিতেন না আপনাদের শিক্ষার্থীদের। কীভাবে দিতেন, ক্লাস, ক্লাস টেস্ট,পরীক্ষা আছে না?
৬। কতিপয় বন্ধু?
একজনের রুম থেকে ভার্সিটি দেখা যায়, আরেকজনকে লোকাল বাসে ২০টাকা ভাড়া দিয়ে ভার্সিটি আসতে হয়। কার ঝুঁকি বেশী সেটা মূর্খ পাগলও বুঝে। বুঝে না খালি কতিপয় স্বার্থপর বন্ধুরা। এরা সত্যিকার বন্ধুর কাতারে পড়ে কিনা, সেটাও চিন্তার বিষয়।
উপরে মাসুদের ঘটনাটি হয়ত কাল্পনিক, কিন্তু এমন ঘটনাই ঘটছে আমাদের চারপাশে। স্কুল, কলেজের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কতিপয় স্বার্থপর বন্ধুদের মনুষ্যত্ব শূন্যের কোঁটায় চলে যাওয়ায়, কতিপয় শিক্ষকদের গোঁড়ামিতে, কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীরবতায় রাজনীতির নোংরা কালচারের বলি হচ্ছে মাসুদের মত নাম না জানা অনেক শিক্ষার্থী। ভুলতে বসেছে, সময়, কাজ, ক্যারিয়ার সব কিছুর চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী। তাই, উপরের কারো মোহে পড়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া কতটা যৌক্তিক তা আমার বোধগম্য নয়। আপনার?
Discussion about this post