আপনি জানেন কি, কেন আন্তর্জাতিকভাবেই বিয়ের বয়স ১৮ বা আঠারোর কাছাকাছি রাখা হয়?
কারণ, আইনত ধরে নেওয়া হয় যে, একজন মানুষ হোক সে নারী, হোক সে পুরুষ, তাকে কোন একটু চুক্তিতে আসতে হলে তাকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। আর, প্রাপ্তবয়স্ক না হলে সে চুক্তিটি না বুঝে স্বাক্ষর করবে, যা ভবিষ্যতে তার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বিবাহকে বলা হয় একটি সামাজিক চুক্তি, যা দুইজন নরনারীকে একসাথে বসবাস এবং সন্তান জন্মদানের অনুমতি প্রদান করে। তো, বিবাহ যেহেতু একটি চুক্তি, সুতরাং সেই চুক্তির একটি পক্ষ হতে হলে আপনাকেও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক হতে হলে আপনাকে ১৮ বছর পূর্ণ করতে হবে। হিসেব বুঝেছেন?
কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে যদি কেউ কোন চুক্তি করে তবে সেটা আইনের ভাষায় ‘void ab initio’। void ab initio ল্যাটিন ভাষা যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘শুরু থেকেই বাতিল’। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ১৮ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে যদি কেউ বিবাহ করে তবে সেটা শুরু থেকেই বাতিল বলে গণ্য হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সে চাইলেই ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারে, আইনবলে।
তো, যখন কেউ অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নিজের সম্মতি ছাড়া ‘শুরু থেকেই বাতিল বিবাহ’ করে এবং এরপর ১৮ হওয়ার আগেই ডিভোর্সও দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় ঐ মেয়েকে বিবাহিত বলে সম্বোধন করা সঠিক নয়। আইনত সে অবিবাহিত। নিজের অনিচ্ছায় একটি বাতিল বিবাহের স্বীকার হওয়া মেয়েকে আমি কোন মতেই বিবাহিত আখ্যায়িত করতে পারি না। নিঃসন্দেহে সে অবিবাহিত।
এখন আসুন, কুমারী প্রসঙ্গ নিয়ে। আমার ঠিক জানা নেই, কেন মিস ওয়াল্ড বা মিস বাংলাদেশ হতে হলে অবিবাহিত হতে হবে, এটা কি কুমারী ইস্যুতে কিনা আমার জানা নেই। তবে যদি সেটা কুমারীত্ব ইস্যু নিয়ে হয়, তাহলে আমার এখানে কিছু প্রশ্ন, যদিও কাউকে অপমান করার ইচ্ছে আমার নেই, তারপরও আমার জানতে ইচ্ছে করে, অবিবাহিত মানেই কি, কুমারী? প্লীজ আরেকবার ভাবুন।
আরেকটা ভিন্ন এঙ্গেল থেকে ভাবুন তো, একজন ধর্ষিতা মেয়ে কি কখনো ‘মিস বাংলাদেশ’ হতে পারবেন না??
আমার পয়েন্ট গুলো যদি আপনি ধরতে পারেন তবে, কেন আমরা এটা মেনে নিতে পারি না যে, একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে এবং সেই বিয়েতে কোন সহবাস হয়ে থাকলে সেটা ‘ধর্ষণ’। একদম সহজ হিসাব, যে বিয়েতে মেয়ের সম্মতি নেই, সেই ছেলের সাথে সহবাসেও তার সম্মতি নেই, আর সম্মতি ছাড়া সহবাস, ‘ধর্ষণ’। জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের জায়গায় একবার নিজের আপন কাউকে বসিয়ে দেখুন, সব হিসেব বরাবর।
শেষ কথা, আমরা সে জাতি যারা মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, কিন্তু আজ এই মেয়ের পাশে না দাঁড়ালে কীভাবে আমাদের intension যে সৎ, সেটা প্রমাণিত হবে??
My confession, জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের সাথে আমার জীবনেও যোগাযোগ হয়নি, এমনকি ফেসবুকেও না। আমি শুধু অনলাইনে তার বক্তব্যটা পড়লাম, তারপর আমার আইন পড়া আর চর্চার সাথে মিলিয়ে আমার যুক্তিটা তুলে ধরলাম। তার বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে আমার এডভাইস, ওর উচিত আইনের আশ্রয় নেওয়া। remedy’র পাশাপাশি ভালো একটা precedent আসতে পারে। আর যদি তার বক্তব্য মিথ্যা হয়, তাহলে আমি নিজেও ভুল সময়ে ভুল মানুষের পক্ষে লেখার জন্য সরি।
যারা পড়েন না, তাদের জন্য
জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের ভাষ্য, “আমি জানি অনেকেই আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন কেন আমি আমার বিয়ের কথা গোপন করেছি। আমি গোপন করেছি কারণ ১৬ বছর বয়সে আমার বাবা আমাকে যে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলো। আমার এই বাল্যবিবাহ আমি মেনে নিতে পারিনি। আর মেনে নিতে পারিনি বলেই আমি আমার জীবনকে আমি নিজের মতো করে নিজের পরিশ্রম দিয়ে আজকে এই অবস্থায় এসেছি। আমার আজকের এই অবস্থান অনেকেই সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু কেউ একবারও ভাবলেন না আমি যে পরিশ্রম করেছি তার কথা। আমি আজকের এই অবস্থান তৈরী করেছিলাম আমার মতো যারা বাল্য বিবাহের শিকার তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আমি চেয়েছিলাম যারা আমার মতো বাল্যবিবাহের শিকার তাদের কাছে নিজেকে একটা উদাহরণ হিসেবে তৈরী করতে যাতে তারাও নিজেদের অবস্থান তৈরী করতে। কিন্তু সবাই আমাকে সে সুযোগ না গিয়ে আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন। হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি আমি বিবাহিত,আমি ডিভোর্সী। এটাইতো আমার অপরাধ। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি। কিন্তু আপনারা কেন একটা বাল্যবিবাহের শিকার একটা মেয়ের সাকসেস মেনে নিতে পারছেন না। আমিতো শুধু এই কারণেই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম যে আমরা মেয়েরা অসহায় হলেও চেষ্টা করলে অনেকদূর যেতে পারি তা দেখানোর জন্য। আর অ্যাজ এ হিউম্যান আমার রাইট আছে, একটা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে গিয়ে নিজেকে প্রেজেন্ট করার। কই আমি তো নিজের জন্য কিছু চাইনি! আমি চেয়েছিলাম আপনাদের দেশের মেয়েগুলোকে জাস্ট দেখিয়ে দিতে যে, একটা মেয়ে চাইলে কী কী পারে। যাই হোক আমার আর কিছু বলার নেই। তবে আমি আজীবন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কাজ করে যাবো,অসহায় মেয়েদের জন্য কাজ করে যাবো।”
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক
এলএলবি, এলএলএম, এসোসিয়েট, আইন গবেষক।
ইমেইলঃ tanbir921535513@gmail.com
Discussion about this post