চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবারও বেড়েছে মানব পাচার। ইয়াবা পাচারের মতো মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ সদস্য ও আইনজীবীর বিরুদ্ধে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং হোটেল মালিকও যুক্ত হয়ে পড়ছেন মানব পাচারে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা দেশের মানব পাচারের অন্যতম রুট। এই দুই জেলাকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। জলপথ ও আকাশপথে প্রায় সময়ই মানব পাচার হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ধরাও পড়ছে। নৌপথে বেশিরভাগ লোককে পাচার করা হয় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। আকাশপথে পাচার করা হচ্ছে ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। পাচারচক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এদিকে আরেকটি চক্র টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশের পাসপোর্টের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ৪ মে চট্টগ্রাম নগরীর জুবিলী রোডের ইউনাইটেড হোটেল থেকে আজিজ, নুর মোস্তফা, ফারুক, ইদ্রিস, আলম ও ফয়সাল নামে ছয় যুবককে আটক করেছে পুলিশ। তারা মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু শহরের বাসিন্দা। পাচারের উদ্দেশ্যে তাদের ওই হোটেলে রাখা হয়। এর সঙ্গে হোটেল মালিক বদিউল আলমও জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। চট্টগাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে মিয়ানমারের ছয় যুবককে ইউনাইটেড হোটেলে রাখা হয়েছিল। বিষয়টি জানার পর ওই যুবকদের আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক সন্তোষ চাকমা জানিয়েছেন, ইউনাইটেড হোটেলের মালিক মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ হোটেল থেকে পাচারের জন্য রাখা লোকজনকে উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের শীর্ষ মানব পাচারকারীদের একজন বাহাদুর আলম। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের মানব পাচারকারী চক্রের তালিকায় ওপরদিকে নাম রয়েছে বাহাদুরের। বাঁশখালী উপজেলার কুতুবখালী গ্রামের বাহাদুর দীর্ঘ দিন ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। এর আগে মালয়েশিয়ায় পাচারকালে কুতুবদিয়া চ্যানেলে ট্রলারডুবিতে ৩২ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই পাচার চক্রের অন্যতম হোতা বাহাদুর বেশ কিছু দিন ধরে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল। পাচারের জন্য নতুন করে মানুষ সংগ্রহ করা শুরু করলে কিছুদিন আগে ফাঁদ পেতে চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি মাঠ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মানব পাচার, হত্যাসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
বাঁশখালী থানার এসআই মো. বাহার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মানব পাচার চক্রের অন্যতম হোতা বাহাদুর আলম। নতুন করে সক্রিয় হয়েছিল সে। ৩২ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলার এই আসামিকে আমরা কিছুদিন আগে গ্রেফতার করেছি।’
সৌদি আবরে মানব পাচারে জড়িত হয়ে পড়ছেন আইনজীবী ও পুলিশের কিছু সদস্যও। গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে মানব পাচারের ঘটনায় মামলা হয় এক আইনজীবী দম্পতির বিরুদ্ধে। মামলায় অ্যাডভোকেট জামাল হোসেন ও তার স্ত্রীসহ পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে গত এপ্রিলের প্রথমদিকে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ করা হয়, বিনা পয়সায় রোহিঙ্গা নারীদের সৌদি আরবে পাচার করে আসছিলেন অ্যাডভোকেট জামাল হোসেন ও তার স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার। প্রলোভন দেখিয়ে দালাল ছলিম মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নারী সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। আর তাদের জাল পাসপোর্ট তৈরি করে চট্টগ্রাম থেকে সৌদি আরব পাঠান অ্যাডভোকেট জামাল। ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে চক্রটি তৈরি করে পাসপোর্ট। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে গ্রেফতার হওয়া তিন রোহিঙ্গা চট্টগ্রামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আইনজীবী জামালের ব্যাপারে এসব তথ্য তুলে ধরে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আইনজীবী জামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার সঙ্গে একদিন ফজলুল কাদের নামে এক ব্যক্তির পরিচয় হলে তাকে শুধু একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
গত বছর ১০ নভেম্বর ইরাকে পাচারকালে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে পাঁচজনকে উদ্ধার করে র্যাব। এর আগে ১২ অক্টোবর একই বিমানবন্দর থেকে লিবিয়ায় পাচারকালে উদ্ধার করা হয়েছিল আরও ৩৯ জনকে। তবে ওই অভিযানের আগেই অবৈধভাবে লিবিয়ায় চলে যায় ২১ ব্যক্তি। সে সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের মাধ্যমে লোকদের এনে ইরাকে পাঠানোর উদ্দেশ্যে ঢাকার ফকিরাপুলের ছায়ানীড় হোটেলে তোল হয়। পরে রবিউল নামে এক দালাল তাদেরকে ভিসা ও পাসপোর্ট দিয়ে যায়।
র্যাব-৭ এর সিনিয়র এএসপি মিনতানুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন সময় বেশকিছু লোককে আমরা উদ্ধার করেছি। একাধিক চক্র মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
গত ৩ মে মানব পচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় খোরশেদ নামে এক কনস্টেবলকে। নগর পুলিশ থেকে সম্প্রতি নবগঠিত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে তাকে বদলি করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক তদন্তে তার নাম উঠে আসে। গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই যাওয়ার সময় দুই যাত্রীকে ভুয়া পাসপোর্টসহ আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। তরা হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে জাহাঙ্গীর ওরফে তপন ও চট্টগ্রামের চন্দনাইশের ফকিরপাড়ার আবুল কাশেমের ছেলে আবুল কালাম। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, কনস্টেবল খোরশেদের কাছ থেকে ভিসা ও পাসপোর্ট নিয়েছে তারা। খোরশেদ পেশাদার মানব পাচারকারী।
-সমকাল
Discussion about this post