জাল ভিসার সাহায্যে পরিচারিকাকে আমেরিকায় নিয়ে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের থেকে কম টাকা দেয়ার অভিযোগে ভারতীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়ে গ্রেফতারের ঘটনায় ভারত-আমেরিকা কুটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। দেবযানী খোবরাগাড়ের গ্রেফতারের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে তলব করে ঘটনাটির ব্যাখ্যা দাবী করেন এবং তার কঠোর ও তীব্র প্রতিবাদ জানান। একই সাথে ভারতে অবস্থিত সকল মার্কিন কুটনৈতিক মিশন এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের সকল প্রকার নিরাপত্তা, দায়মুক্তি ও সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেন যেসব অধিকার, দায়মুক্তি ও সুযোগ সুবিধা তারা ভিয়েনার কূটনৈতিক সম্পর্কের কনভেনশন অনুযায়ী পেয়ে আসছিল।
বিশ্বের অধিকাংশ জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই আন্ত:রাষ্ট্রীয় কুটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও তার কোন আইনগত স্বীকৃতি ছিল না। ফলে সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতাসহ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা এবং জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ বিষয়ক জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতিকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ এক সময়য় একটি সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনগত কাঠামো (কনভেনশন)’র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যে কনভেনশনের মাধ্যমে কুটনৈতিক সংসর্গ, অধিকার ও দায়মুক্তি নিশ্চিতকরনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। তবে প্রদত্ত অধিকার ও দায়মুক্তি কোনভাবেই ব্যক্তি স্বার্থে নয় বরং কুটনৈতিক মিশনসমূহের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রযোজ্য হবে।
কুটনৈতিক অধিকার, দায়মুক্তি ও সুযোগ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে কোন জটিল প্রশ্নের উদ্ভব ঘটলে প্রচলিত প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সমাধানের সুযোগ রেখে ১৯৬১ সালের ১৮ এপ্রিল ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কূটনৈতিক আদান-প্রদান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিনিধি সম্মেলনে ভিয়েনার কূটনৈতিক সম্পর্কের কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২৪ এপ্রিল এ কনভেনশন কার্যকরী হয়। এই চুক্তির ৫৩টি ধারা রয়েছে। বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিবিদদের গ্রহণ করা, স্তর বিন্যাস, বিশেষ অধিকার, দেশের অধিকার ও দায়িত্ব এতে নির্ধারিত বর্নিত হয়েছে। এ কনভেনশন স্বাক্ষরের সাথে সাথে আরও দুটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এই কনভেনশনের ২২ ধারা অনুযায়ী দুতাবাসে মিশন প্রধানের অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করা যায় না এবং দূতাবাসের ভবন রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহনকারী রাষ্ট্রের। আবার ২৪ ধারা অনুযায়ী দুতাবাসের দলিল পত্র, এমনকি দুতাবাসের বাহিরে সংরক্ষিত দলিলপত্রের সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। তাছাড়া, ২৭ ধারা অনুযায়ী তাদের অবাধ যোগাযোগের নিশ্চয়তা প্রাদান করতে হবে। আবার ২৯ ধারা অনুযায়ী দুতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দের নিরাপত্তার বেঘাত করা যায় না অর্থাৎ তাদের গ্রেফতার ও ডিটেনশন থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। একইসাথে ৩১ ধারা অনুযায়ী তারা ফৌজদারী মোকদ্দমা, দেওয়ানী মোকদ্দমা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাগ্রহণ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার অধিকারী। পাশাপাশি ৩০ ধারা অনুযায়ী তাদের বাসস্থান, যোগাযোগ ও সম্পদের উপর আক্রমণ করা যায় না এবং দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আচরণ ও ভ্রমণ অবাধ থাকবে। তাছাড়া, তারা কর মওকুফ পাওয়া, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করার অধিকারী।
সর্বোপরি, ১৯৬৩ সালের কনসুলার সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের ৫৩(২) ধারা অনুযায়ী কনসুলার অফিসারদের পরিবারের সদস্য অথবা তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীরাও ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিক দায়মুক্তি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী।
লেখক: অ্যাডভোকেট শাহানুর ইসলাম, একজন তরুন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; একটি শিশুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত; ইমেইল: saikotbihr@gmail.com; www.shahanur.blogspot.com
Discussion about this post