ভারতে তিন তালাক বললে আর তালাক হবে না, আদালত নাকি এরকম কিছু একটা বলেছে। যে আমাকে জানালো খবরটি, তার কণ্ঠে উপচে পড়ছিল আনন্দ, যেন বড় কোনও বিজয় জুটেছে। শুনে আমি কোনও উচছ¡াস প্রকাশ করিনি। কারণ যে দেওয়াল এখন ভেঙে ফেলা প্রয়োজন, সেই দেওয়ালের গায়ে একটি ফুটো করতে পারা এমন কোনও বীরত্ব নয়। ভারতের মুসলমানরা এখনও শরিয়া আইনে চলে। পুরুষরা তালাক বললেই তালাক হয়ে যায়, স্ত্রীদের অবশ্য অধিকার নেই স্বামীকে তালাক দেওয়ার। চাইলেই চারটি বিয়ে করতে পারে যে-কোনও মুসলমান পুরুষ। না, মেয়েদের চারটে বিয়ে করার কোনও অধিকার নেই।<br /> হায়দরাবাদের এক মুসলমান মেয়ে সেদিন বলেছিল-‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে আমাদের ভালই হয়।’ আমি আঁতকে উঠেছিলাম শুনে, বলে কী মেয়ে! বিজেপি আবার মুসলমানের কী মঙ্গল করবে অমঙ্গল ছাড়া? মেয়েটি বলল-‘বিজেপি সারা ভারতে ১৯৫৬ সালের হিন্দু অ্যাক্ট চালু করবে, যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে বর্বর স্বামীকে তালাক দেওয়ার এবং একাধিক স্ত্রী নিয়ে সংসার সাজাবার আরামটি পুরুষরা আর পাবে না।’<br /> মেয়েটি আমাকে ভাবিয়েছিল বটে। এ-রকম সাধারণ, নির্বিরোধ, প্রগতির পক্ষের মেয়েকেই যদি নারী-পুরুষের সমান অধিকারের জন্য বিজেপির পক্ষ নিতে হয় তবে লজ্জা কি সেই মেয়ের একার না তাবৎ মুসলমানের! কেন তাকে ভারতে উগ্র মৌলবাদী একটি দলকে সমর্থন করতে হয়? ক’দিন আগেই বিজেপির দিল্লি অফিসে ভারতের মুসলমান নেতারা জুম্মার নামাজ আদায় করেছে। এর পেছনে রাজনীতির জিলিপি আছে, তা জানি। এক দল আরেক দলকে পেলে মনে হয় কচুকাটা করবে। সব আসলে ওপর ওপর। এ কেবল নেতাদের বেলায় ঘটে। দুর্ভোগ হয় সাধারণের- যারা জট বোঝে না, ঘট বোঝে না।<br /> বাংলাদেশেও ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারি করা হয়। শরিয়া আইনের চেয়ে খুব একট তফাৎ এতে নেই, তবু তালাক উচচারণ করলেই তালাক হয় না, ইউনিয়ন পরিষদের কাছে নোটিস দিতে হয়, সেই নোটিসের কপি স্ত্রীকে দিতে হয় এবং নোটিস দেওয়ার নব্বই দিন (স্ত্রী তিনবার ঋতুমুক্ত হলে তার গর্ভে যে স্বামীর সন্তান নেই-এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্যই নব্বই দিনের এই হিসেব) পর তা কার্যকর হয়। এর কোনও একটি শর্তপূরণ না হলে নব্বই দিন অর্থাৎ ইদ্দতকাল পার হবার পরও তালাক কার্যকর হয় না। ‘বহুবিবাহের’ বেলায়ও সালিশি পরিষদের অনুমতি লাগে, স্ত্রী বা স্ত্রীদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশেও এক সময় শরিয়া আইন চলেছে, আজ সেই আইনে যে যৎসামান্য পরিবর্তন হয়েছে, সেটুকুর হাওয়াও, বড় বিস্ময়এই, এতদিনে ভারতের গায়ে লাগে নি। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যদি তার সব ধর্মবিশ্বাসী নাগরিকের জন্য একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ আইন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তবে সেই দেশের ধর্মনিরপেক্ষতায় আমার অন্তত কোনও পক্ষপাত নেই। যদি বলা হয়, মোল্লারা মানে না, বাগড়া দেয়-তারও উত্তর আছে-তারা মানবে না বলে রাষ্ট্র কেন কিছু করবে না! ঘরে মরা ইঁদুর রেখে সুগন্ধি রুমাল চাপলেই কি দুর্গন্ধ যায়! মোল্লারা কবে একটু ছাড় দেবে তা মুসলমান মেয়েরা (শরিয়ার পাথর তো কেবল মেয়েদেরই চাপে) হাঁফ ছাড়বে-ভারতের মতো অগ্রসর দেশে এ নিয়ম চলা উচিত নয়।<br /> বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। মেয়েরা তালাক দিতে পারবে কি পারবে না-কাবিন নামায় নাকি এ-রকম একটি প্রশ্ন জুড়ে দেওয়া হয়। স্বামীরা যদি করুণা করে মেয়েদের তালাক দেবার অধিকার দেন, তবেই হতভাগীরা সেই অধিকার পায়, তা না হলে তালাক দিতে আদালতে দৌঁড়াতে হয়, কারণ দর্শাতে হয়। কারণগুলো আবার আইনের কারণের সঙ্গে মিলতে হয়। স্বামী ধ্বজভঙ্গ নয়, স্বামী আমাকে পেটাচেছ না, স্বামী আমাকে ভাত-কাপড় দিচেছ কিন্ত স্বামীকে আমি ভালবাসি না বলে স্বামীকে ত্যাগ করতে চাইছি, এ-কথা কেউ শুনবে না। তালাক হবে না। দেশের বড় বড় নায়িকা-গায়িকাদেরও এই তালাকের অধিকার থাকে না, তাদের তাই মামলা করে বর্বর স্বামীকে তালাক দিতে হয়। মুসলমানরা সব ছাড়ে, কিন্ত শরিয়া আইন ছাড়ে না।<br /> এই সব অনাচারের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে মুক্তি শুধু যে মুসলমানের নেই তা নয়, মুক্তি মানুষেরই নেই। গোটা উপমহাদেশে হিন্দু, ইসলামসহ নানা ধর্ম নিয়ে যে তান্ডব, মানুষকে যুক্তিহীন, বোধহীন করার যে হীন চক্রান্ত- তা যদি এখনও সমুলে বিনাশ করা না যায় তবে অচিরে হাঁ-মুখো অন্ধকার আমাদের এমন গ্রাস করবে যে আমরা আর আমাদের পড়শি চিনব না, স্বজন চিনব না, আমরা নিজেকে চিনতেও ভুল করব এবং আত্মঘাতী হবো।<br /> লেখক: কলামিস্ট</p>
Discussion about this post