সোয়েবুর রহমান সোয়েব
আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো দেওয়ানী মোকাদ্দমার শুনানির দিনে বাদী উপস্থিত কিন্তু বিবাদী অনুপস্থিত এবং বিবাদী উপস্থিত কিন্তু বাদী অনুপস্থিত বা উভয় পক্ষগণ গড়হাজির থাকলে এর পরিণাম কি এবং কি প্রতিকার দেওয়া আছে সেসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা হলো। তাই আলোচনার সুবিধার্থে এই প্রসঙ্গে যাবতীয় নিয়মাবলী দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮-এর আদেশ ৯ বিধি ১-১৪-তে লিপিবদ্ধ করা আছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল-
তাহলে চলুন জেনে নিই দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮-এর আদেশ ৯ বিধি ১-১৪-তে কি কি লিপিবদ্ধ আছে:
আদেশ-৯ বিধি-১: বিবাদীর হাজিরার ও জবাব দানের জন্য সমনে নির্ধারিত তারিখে পক্ষগণের হাজিরাঃ বিবাদীর উপস্থিতির এবং জবাব দানের জন্য সমনে নির্ধারিত তারিখে পক্ষগণ ব্যক্তিগতভাবে বা তাদের স্ব স্ব উকিলের মাধ্যমে বিচারালয়ে হাজিরা দিবেন, এবং তখন আদালত কর্তৃক ভবিষ্যতের কোন দিন পর্যন্ত মামলার শুনানি মূলতবী না হলে মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
আদেশ-৯ বিধি-২: বাদী কর্তৃক খরচ প্রদানে অপারগতার জন্য সমন জারী না হলে মামলা খারিজ করা যায়ঃ যদি এরূপ নির্ধারিত তারিখে দেখা যায় যে বাদী কোট ফি না দেয়ায় বা এরূপ সমন জারীর জন্য ব্যয়যোগ্য ডাকা মাশুল (যদি লাগে)। না দেয়ার ফলে বিবাদীর উপর সমন জারী হয়নি, তবে আদালত মামলা খারিজ হওয়া মৰ্মে আদেশ দিতে পারেনঃ
তবে শর্ত থাকে যে, বিবাদীর উপর যদি সমন জারী না হয়ে থাকে, তবে অনুরূপ প্রদান করা যাবে না, যদি তার হাজিরা ও জবাব দানের জন্য নির্ধারিত তারিখে সে ব্যক্তিগতভাবে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি থাকলে, সে প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজির হয়।
আদেশ-৯ বিধি-৩: কোনপক্ষই হাজির না হলে মামলা খারিজ হবেঃ মামলা শুনানির জন্য ডাকা হলে যদি কোন পক্ষই উপস্থিত না হয়, তবে আদালত মামলা খারিজ হওয়া মর্মে আদেশ প্রদান করতে পারেন।
আদেশ-৯ বিধি-৪: বাদী নতুন মামলা করতে পারে বা আদালত মামলাটি নথিতে পূণর্বহাল করতে পারেনঃ যেক্ষেত্রে কোন মামলা ২ বা ৩ বিধির অধীনে খারিজ করা হয়, সেক্ষেত্রে বাদী (তামাদি আইন সাপেক্ষে) নতুন মামলা দায়ের করতে পারবে, অথবা সে খারিজের আদেশ রদ করার আবেদন করতে পারে, এবং সে যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোর্ট ফি বা সমন জারীর জন্য ডাক মাশুল (যদি লাগে) দিতে না পারার অথবা উপস্থিত হতে না পারার জন্য যথেষ্ট কারণ ছিল বলে আদালতকে সম্ভষ্ট করতে পারে, তবে আদালত মামলার খারিজ আদেশ রদের আদেশ দান করবেন এবং মামলার কার্য ধারা পরিচালনার জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন।
আদেশ-৯ বিধি-৫: বিনা জারীতে সমন ফেরত আসার পরে তিন মাসের মধ্যে বাদী নতুন সমন দেয়ার আবেদন করতে ব্যর্থ হলে মামলা খারিজ করাঃ
(১) যেক্ষেত্রে, বিবাদীকে বা কতিপয় বিবাদীদের কোন একজনের প্রতি সমন দেয়া হলে এবং তা বিনাজারীতে ফেরত আসিলে, আদালতের যে কর্মচারী সাধারণতঃ সমন জারীর বিষয়ে আদালতের কাছে প্রত্যয়ন করেন, তিনি প্রত্যয়ন পূর্বক সমন ফেরত দেয়ার তিন মাসের মধ্যে বাদী যদি নতুন সমন দেয়ার জন্য আবেদন না করে, তবে আদালত এরূপ বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলাটি খারিজের আদেশ দিবেন, যদি না বাদী উক্ত সময়ের মধ্যে আদালতকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে পারে যে—
ক) যে বিবাদীর উপর সমন জারী হয়নি, বাদী যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সেই বিবাদীর বাসস্থানের বাহির করতে অপারগ হয়েছে, বা
খ) উক্ত বিবাদী পরোয়ানা জারী এড়াইয় চলিতেছে, বা
গ) সমনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য অন্য কোন যথেষ্ট কারণ রয়েছে, যে ক্ষেত্রে আদালত নতুন সমন দেয়ার জন্য আবেদনের সময়ের মেয়াদ প্রয়োজনবোধে বৃদ্ধি করতে পারেন।
(২) অনুরূপ ক্ষেত্রে বাদী (তামাদি আইন সাপেক্ষে) নতুন মামলা দায়ের করতে পারেন।
আদেশ-৯ বিধি-৬: সমন যথারীতি জারী হওয়ার পরে কেবল বাদী হাজির হলে কার্য-পদ্ধতিঃ
(১) যেক্ষেত্রে মামলাটি শুনানির জন্য ডাকা হলে বাদী উপস্থিত হয় এবং বিবাদী উপস্থিত হয় না, সেক্ষেত্রে তখন
ক) যদি প্রমাণ হয় যে, সমন যথারীতি জারী হয়েছে, তবে আদালত একতরফাভাবে গ্রসর হতে পারেন;
খ) যখন সমন যথারীতি জারী না হয়ঃ যদি প্রমাণ না হয়, যে সমন যথারীতি জারী হয়েছে, তবে আদালত বিবাদীর উপর দ্বিতীয় বার সমন প্রেরণেরও জারীর নির্দেশ প্রদান করবেন;
গ) যেক্ষেত্রে সমন যথারীতি জারী হয়, কিন্তু উপযুক্ত সময়ের মধ্যে নহেঃ যদি প্রমাণ হয় যে, বিবাদীর উপর সমন জারী হয়েছে, কিন্তু বিবাদীকে সমনে নির্ধারিত তারিখে উপস্থিত হয়ে জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়নি, তবে আদালত ভবিষ্যতের কোন নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত মামলার শুনানি স্থগিত রাখবেন এবং বিবাদীকে সেই তারিখ জ্ঞাত করার নির্দেশ দিবেন।
(২) যদি বাদীর ক্রটির দরুণ যথারীতি সমন জারী না হয়, বা যথেষ্ট সময়ের মধ্যে জারী না হয়, তবে আদালত মামলার মুলতবীর দরুন যে খরচ হবে, তা বাদীকে পরিশোধের আদেশ দান করবেন।
আদেশ-৯ বিধি-৭: যেক্ষেত্রে বিবাদী তার স্থগিত শুনানির দিনে হাজির হয়ে তার পূর্ববর্তী অনুপস্থিতির জন্য উপযুক্ত কারণ দর্শায়, সেক্ষেত্রে পদ্ধতিঃ যেক্ষেত্রে আদালত মামলার একতরফা শুনানি স্থগিত রেখেছেন এবং বিবাদী উক্ত শুনানি চলাকালে বা তৎপূর্বে উপস্থিত হয়, এবং তার পূর্ববতী অনুপস্থিতির উপযুক্ত কারণ দর্শায়, খরচা সম্পর্কে বা অন্য কিছু সম্পর্কে আদালত যেরূপ শর্তসমূহ আরোপ করেন, তৎসাপেক্ষে মামলার জবাবে তার বক্তব্য শ্রবণ করা যাবে, যেন তার উপস্থিতির জন্য নির্ধারিত তারিখেই সে উপস্থিত হয়েছে।
আদেশ-৯ বিধি-৮: কেবলমাত্র বিবাদী উপস্থিত থাকলে কার্য-পদ্ধতিঃ যেক্ষেত্রে মামলাটি শুনানির জন্য ডাকা হলে বিবাদী উপস্থিত হয়, এবং বাদী উপস্থিত হয় না, সেক্ষেত্রে আদালত মামলা খারিজ হওযা মৰ্মে আদেশ দান করবেন, যদি না বিবাদী বাদীর দাবী বা উহার অংশ বিশেষ স্বীকার করে, যেক্ষেত্রে আদালত এরূপ স্বীকারোক্তির উপর বিবাদীর বিরুদ্ধে ডিক্রি প্রদান করবেন এবং যেক্ষেত্রে দাবীর অংশ বিশেষ স্বীকার করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট দাবী সম্পর্কে মামলাটি খারিজ করবেন।
আদেশ-৯ বিধি-৯: ক্রটির ফলে বাদীর বিরুদ্ধে ডিক্রি হলে নতুন মামলায় বাধাঃ
(১) যেক্ষেত্রে ৮ বিধি অনুসারে কোন মামলা আংশিক বা সামগ্রিকভাবে খারিজ হয়, সেক্ষেত্রে একই কারণ সম্পর্কে বাদীকে নতুন মামলা দায়ের করতে নিবারণ করা হবে। কিন্তু বাদী মামলা খারিজের আদেশ রদ করার জন্য আবেদন করতে পারবে, এবং সে যদি আদালতকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, মামলাটি শুনানির জন্য ডাকার সময় তার অনুপস্থিতির জন্য যথেষ্ট কারণ ছিল, তাহলে আদালত মামলার ব্যয় সম্পর্কে যথাবিহিত শর্ত সাপেক্ষে বা অন্য কোনভাবে, যাই তিনি সঙ্গত মনে করেন, মামলা খারিজের আদেশ রদ করবেন, এবং মামলার কার্যধারা পরিচালনার জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন।
(২) বাদীর আবেদন সম্পর্কে কোন নোটিশ অপর পক্ষকে না দিয়া অত্র বিধি অনুসারে কোন আদেশ দেয়া যাবে না।
আদেশ-৯ বিধি-১০: কতিপয় বাদীর এক বা একাধিক অনুপস্থিত থাকলে কার্য-পদ্ধতিঃ যেক্ষেত্রে একাধিক দাবী রয়েছে, এবং যদি একজন বা তাদের একাধিক জন উপস্থিত হয়, এবং অন্যান্যরা উপস্থিত না হয়, সেক্ষেত্রে আদালত বাদীদের মধ্যে উপস্থিত বাদী বা বাদীদের অনুরোধক্রমে মামলাটি একইভাবে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি প্রদান করবেন, যে সকল বাদীই উপস্থিত হয়েছে অথবা যেরূপ সঙ্গত মনে করেন সেরূপ আদেশ প্রদান করবেন।
আদেশ-৯ বিধি-১১: কতিপয় বিবাদীর এক বা একাধিক অনুপস্থিত থাকলে কার্য-পদ্ধতিঃ যেক্ষেত্রে একাধিক বিবাদী রয়েছে, সেক্ষেত্রে একজন বা কয়েকজন বিবাদী উপস্থিত হয়, এবং অন্যরা উপস্থিত না হয়, সেক্ষেত্রে মামলাটি অগ্রসর হবে এবং রায় ঘোষণার সময় আদালত অনুপস্থিত বিবাদীদের সম্পর্কে উপযুক্ত যেকোন আদেশ দান করবেন।
আদেশ-৯ বিধি-১২: ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়ার পর অনুপস্থিতির যথেষ্ট কারণ না দর্শালে ফলাফলঃ যেক্ষেত্রে কোন বাদী বা বিবাদীকে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে যদি উক্ত বাদী বা বিবাদী ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত না হয়, বা আদালতের সন্তুষ্টি অনুসারে তার অনুরূপ উপস্থিত হতে ব্যর্থতার জন্য যথেষ্ট কারণ না দর্শায়, তাহলে বাদী ও বিবাদীদের অনুপস্থিতি সম্পর্কিত পূর্ববর্তী বিধিমালায় বর্ণিত বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে।
আদেশ-৯ বিধি-১৩: বিবাদীর বিরুদ্ধে একতরফা ডিক্রি রদকরণঃ যে কোন মামলায় কোন বিবাদীর বিরুদ্ধে একতরফা ডিক্রি দেয়া হয়ে থাকলে, সে ডিক্রি প্রদানকারী আদালতে উহা রদ করার আদেশ দানের জন্য আবেদন করতে পারে, এবং যদি সে আদালতকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, সমন যথারীতি জারী হয়নি, অথবা যখন মামলাটি শুনানির জন্য ডাকা হয়েছিল, তখন সে কোন যথেষ্ট কারণে উপস্থিত হওয়া হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল, তবে আদালত, মামলার ব্যয় আদালতে পরিশোধ বা অন্য কোন শর্ত সাপেক্ষে, যা সঙ্গতঃ মনে করা হয় ডিক্রিটি রদ করে আদেশ প্রদান করবেন এবং মামলার কার্যধারা পরিচালনার জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করবেনঃ
তবে শর্ত থাকে যে, ডিক্রিটি যদি এরূপ প্রকৃতির হয় যে, উহা কেবল উক্ত বিবাদীর বিরুদ্ধে রদ করা যাবে না, তবে ইহা অন্যান্য সকল বা অন্য যে কোন বিবাদীর বিরুদ্ধেও রদ করা যাবে।
আদেশ-৯ বিধি-১৪: অপরপক্ষকে নোটিশ প্রদান না করে কোন ডিক্রি রদ করা যাবে নাঃ উপরে বর্ণিত মতে এরূপ কোন আবেদনের প্রেক্ষিতে কোন ডিক্রি রদ করা যাবে না, যদি না, বিরোধী পক্ষের উপর ইহার কোন নোটিশ জারী হয়ে থাকে।
আদেশ-৯ বিধি-১৫: যেক্ষেত্রে কোন মামলার খারিজের আদেশ ৪ অথবা ৯ বিধির অধীনে অথবা ১৩ বিধির অধীনে কোন ডিক্রি রদ করা হয়, সেক্ষেত্রে মামলাটি পুনর্বহাল করার প্রেক্ষিতে খারিজের আদেশ প্রদান বা ডিক্রি প্রদানের অব্যবহিত পূর্বে যে স্তরে ছিল, ঠিক সে স্তর হতে মামলাটি চালু করা হবে।
উপরের যাবতীয় নিয়মাবলী ৯ আদেশের ১-১৪ বিধিটি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে-
শুনানির দিনে উভয় পক্ষ উপস্থিত না হলেঃ মামলার শুনানির জন্য ডাকা হলে যদি কোনো পক্ষ হাজির না থাকে, তাহলে আদালত মামলা খারিজের আদেশ দান করতে পারবেন। এই অনুসারে মামলা খারিজ হলে বাদী একই কারণে বা খারিজের আদেশ রদ করার জন্য আবেদন করতে পারবে এবং তদবস্থায় বাদী যদি আদালতের সন্তুষ্টিমত নির্দিষ্ট তারিখে হাজির না হওয়ার উপযুক্ত কারণ দর্শাতে পারে, তবে আদালত খারিজের আদেশ রদ করে মামলা বিচারের জন্য একটি তারিখ দিবেন।
শুনানির দিনে বাদী উপস্থিত কিন্তু বিবাদী অনুপস্থিত হলেঃ শুনানির দিনে বাদী উপস্থিত কিন্তু বিবাদী অনুপস্থিত হলে এবং এইক্ষেত্রে শুনানীর জন্য মামলার ডাকা হলে যদি বাদী হাজির থাকে, কিন্তু বিবাদী হাজির না হয়, তবে মামলার সমন যথারীতি মত জারি হলে, বাদী পক্ষের সাক্ষ্য দিয়ে আদালত একতরফা নিষ্পত্তি করতে পারেন। সমন যথারীতি মত জারি না হলে আদালত পুনরায় জারির আদেশ দিবেন। বিবাদী উপস্থিত হয়ে যদি মামলার লিখিত জবাব দেয় বা জবাব দেয়ার জন্য সময়ের প্রার্থনা করে, তবে আদালত একতরফা নিষ্পত্তি না করে অবস্থানুযায়ী অন্য আদেশ দিতে পারবেন।
শুনানির দিনে বিবাদী উপস্থিত কিন্তু বাদী অনুপস্থিত হলেঃ শুনানির দিনে বিবাদী উপস্থিত কিন্তু বাদী অনুপস্থিত হলে এবং এইক্ষেত্রে শুনানীর জন্য মামলার ডাকা হলে যদি বিবাদী হাজির থাকে, কিন্তু বাদী হাজির না হয় তবে বিবাদী বাদীর দাবি বা উহার অংশ স্বীকার না করে তাহলে আদালত মামলা খারিজের আদেশ দিবেন। বিবাদী বাদীর দাবি বা উহার অংশ স্বীকার করে নেয়, তবে আদালত সেই অনুপাতে বিবাদীর বিরুদ্ধে ডিক্রি দিবেন এবং বাদীর অবশিষ্ট দাবি সম্পর্কে মামলা খারিজের আদেশ দিবেন। কোনো মামলা আংশিক বা সামগ্রিকভাবে খারিজ হয়, সেক্ষেত্রে একই কারণে বাদী নতুন মামলা দায়ের করতে পারবে না, কিন্তু বাদী মামলা খারিজের আদেশ রদ করার জন্য আদেশ করতে পারবেন। বাদী যদি মামলার ধার্য্য তারিখের দিন অনুপস্থিত থাকার সন্তোষজনক কারন ব্যাখ্যা করতে পারে তাহলে আদালত খারিজের আদেশ রদ করবেন এবং মূল মোকাদ্দমা বিচারের জন্য একটি ধার্য্য তারিখ দিবেন। এই অবস্থায় মামলা খারিজের আদেশ রদ করার আগে বিবাদীকে বাদী হতে উপযুক্ত বিষয়ে বাদীর আবেদন সম্পর্কে অপর পক্ষকে নোটিশ না দিয়ে অত্র বিধি অনুযায়ী কোনো আদেশ দেয়া যাবে না।
উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সমূহঃ
★ একাধিক বিবাদীর ক্ষেত্রে: আদেশ ৬ বিধি ১৪- একাধিক বিবাদীর ক্ষেত্রে ঐ একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। একজন বিবাদী যদি অন্যান্য সকল বিবাদীদের পক্ষে কোনো আবেদনের জবাবে সহি করে এবং তাহারা সবাই যদি একজন মাত্র কৌঁসুলির দ্বারা প্রতিনিধি প্রাপ্ত হয় তাহা হইলে ঐ জবাব সহ বিবাদীর দ্বারা স্বাক্ষরিত হইয়াছে বলিয়া অনুমিত হইবে। [১৯৮০ সি এল সি ১১৫০]
★ কৌঁসুলি বা তার কেরানী বিবাদী মোয়াক্কেলকে সময়মত শুনানীর তারিখ না জানাইলে উহাও এক তরফা ডিক্রি রদের জন্য একটি সংগত কারণ বলিয়া ধরা হইবে। কৌঁসুলি বা তার কেরানীর জন্য বিবাদী দায়ী নহে। [(১৯৬৬)১৮ ডি এল আর ৪৮১]
★ নির্ধারিত দিবসে বিবাদীর অনুপস্থিতিতেই কেবল একতরফা কার্যক্রম গ্রহন করা যায়। [(১৯৬৪) ১৬ ডি এল আর (এসসি)১৫৫]
★ আদেশ ৯ নিয়ম ৭- এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে যে মৌলিক নীতিটি প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য চাওয়া হইয়াছে তাহা হইতেছে, একতরফা রায় প্রদান করিবার পূর্ব পর্যন্ত বিবাদী যেকোনো সময় মামলায় উপস্থিত হইয়া আত্মরক্ষার সুযোগ নিতে পারে। [পিএলডি ১৯৮৩ কোয়েটা ১]
★ আদেশ ৯ নিয়ম ৭- এই নিয়মটি মূলতঃ বিবাদীকে আইনত সমর্থনকারি একটি নিয়ম, হরনকারি কোনো নিয়ম নহে। ইহার মূল বক্তব্য হচ্ছে বিবাদী তাহার অনুপস্থিতিতে সন্তোষজনক কারণ দেখাইতে পারলে আদালত তাহার গৃহীত যেকোনো একতরফা কার্যক্রম বাতিল করিয়া বিবাদীর এইরুপ শুনানি গ্রহন করিতে পারেন যেন সে নির্ধারিত তারিখেই উপস্থিত হইয়াছে। [পিএলডি ১৯৭৫ লাহোর ৮৭৯]
★ আদেশ ৯ নিয়ম ৭- বিবাদী তাহার বিরুদ্ধে প্রদত্ত একতরফা পদক্ষেপ বাতিল করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়া যাইতে চাইলে তাকে তার পূর্ববর্তী অনুপস্থিতির যুক্তিসংগত ও সন্তোষজনক কারণ প্রদর্শন করিতে হইবে।[পিএলডি ১৯৬৪ লাহোর ৭৮২]
একতরফা ডিক্রি কি?
একতরফা ডিক্রি সম্বন্ধে আলোচনার আগে জানতে হবে একতরফা কী? ‘একতরফা’- বিষয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘আইন শব্দকোষ’ গ্রন্থে মন্তব্য প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন- ‘অন্যপক্ষের অনুপস্থিতিতে আদালত কর্তৃক বিচারে অগ্রসর হওয়া। কেবল আবেদনকারীর আর্জি শ্রবণ করে আদালত যখন কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তখন তা একতরফাভাবে করা হয়।’ বাংলাদেশে এ শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও পৃথিবীর নানা দেশে এর পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- ইংল্যান্ডে বর্তমানে ‘এক্সপারটি’ শব্দটির পরিবর্তে ‘উইদাউট নোটিস’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে জানা যায় একতরফা হচ্ছে আদালত কর্তৃক প্রদত্ত এক প্রকারের ডিক্রি। ‘মামলাটি বাতিল হয়েছে’- এ মর্মে প্রদত্ত কোনো আদেশ যদি ডিক্রিতে পরিণত হয় তবে সেটা আপিলযোগ্য। মামলা না চালানোর কারণে কোনো মামলা বা আপিল খারিজ হলে তা কোনো ডিক্রিতে পরিণত হয় না। মামলায় কোর্ট ফি অপরিশোধিত থাকার কারণে যদি আদালত আরজি প্রত্যাখ্যাত হওয়া মর্মে কোনে আদেশ প্রদান করে মামলা খারিজ করেন, তবে আরজি প্রত্যাখ্যাত হওয়া মর্মে প্রদত্ত আদেশটিতে ডিক্রির কার্যকারিতা থাকবে।
দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ৩ বিধিতে বলা হয়েছে, আদালতে মামলা শুনানির জন্য ডাক পড়লে বাদী উপস্থিত, কিন্তু বিবাদী অনুপস্থিত থাকলে, সে ক্ষেত্রে আদালত মামলাটির একতরফা বিচার করতে পারেন।
নির্ধারিত ধার্য তারিখে পক্ষগণ হাজির না থাকলে বা বাদী খরচ প্রদানে ব্যর্থ হলে অথবা বাদী নির্দিষ্ট সময়ে সমন না দিলে বা যথাসময়ে সমন জারি না হলে কিংবা শুনানির তারিখে অথবা মুলতবি শুনানির তারিখে পক্ষ হাজির না হলে ইত্যাদি কারণে আদালত বা আপিল আদালত মামলা খারিজ, ডিসমিস বা একতরফা করতে পারেন।
এইভাবে যেসকল মামলা নিষ্পত্তি হয় তাকেই বলে একতরফা ডিক্রি আর উভয় পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিয়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হলে তাকে বলে দোতরফাসূত্রে ডিক্রি।
এ অবস্থায় উক্ত একতরফা আদেশের বিরুদ্ধে ওই আদেশ রদ বা রহিত করতে সংশ্লিষ্ট আদালতে দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ৪ ও ১৩ বিধিতে, ৪১ আদেশের ১৯ ও ২১ বিধিতে প্রতিকারের জন্য প্রার্থিত মামলাকে ‘একতরফা মামলা’ বলে।
বাংলাদেশের প্রচলিত দেওয়ানি কার্যবিধি-১৯০৮-এর আদেশ ৯-এর বিধি ৬ এবং ৭; আদেশ ১৭-এর বিধি ২ এবং আদেশ ৪১-এর বিধি ১৭-তে একতরফা বিচার সম্পর্কে বিধান রয়েছে।
আদেশ ৯-এর বিধি ৬ মোতাবেক যদি বিবাদী হাজির না হন এবং প্রমাণিত হয়, সমন সঠিকভাবে জারি করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে আদালত একতরফাভাবে বিচার করতে পারেন। পাশাপাশি ১৭ আদেশের ২ বিধির বিধান মোতাবেক সময়ের প্রার্থনা মঞ্জুর হওয়ার পর ধার্য তারিখে বিবাদী হাজির না থাকলে আদেশ ৯-এর বিধান মোতাবেক একতরফা বিচার হবে। আদেশ ৪১-এর বিধি ১৭ মতে একতরফা আপিলের বিচার সম্পর্কে বিধান রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুনানি মুলতবি হলে পরবর্তী তারিখে আপিলের শুনানির জন্য ডাক পড়লে আপিলকারী যদি হাজির না হন, তবে আদালত আপিল খারিজের আদেশ দিতে পারেন; যদি আপিলকারী হাজির হন কিন্তু প্রতিবাদী হাজির না হন, তবে একতরফা আপিলের শুনানি হবে।
কোনো মামলা একতরফা আদেশ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পদক্ষেপঃ কোনো মামলা খারিজ, ডিসমিস বা একতরফা হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করতে হয়। যথা- (১) বাদী আদালতের সন্তুষ্টি মতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোর্ট ফি বা সমন জারির ডাকমাসুল দিতে না পারায় অথবা হাজির না হওয়ার উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে; (২) শুনানির জন্য ডাকে বাদী হাজির না থাকলে কিন্তু বিবাদী হাজির থাকলে বাদী মামলা খারিজের আদেশ রদ করার জন্য শুনানির দিন বাদী অনুপস্থিত থাকার সন্তোষজনক কারণ দর্শিয়ে; (৩) বিবাদী শুনানির দিনে তার ওপর যথারীতি সমন জারি হয়েছে মর্মে সন্তোষজনক কারণ দর্শিয়ে যে আদালত মামলাটি খারিজ ডিসমিস বা একতরফা আদেশ প্রদান করেন সেই আদালতে একতরফা খারিজ আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে খারিজ আদেশ বাতিল, রদ ও রহিত করে মূল আদেশ প্রার্থনা করতে হয়।
প্রচলিত আইনের বিধান মোতাবেক যে সকল ক্ষেত্রে ছানি মামলা দায়ের করা যায়, সেগুলো হলো-
(১) বাদী খরচ না দেয়ায় সমন জারি না হয়ে থাকলে কিংবা কোনো পক্ষ হাজির না হলে; দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ৪ বিধি অনুযায়ী ছানি মামলা করা যায়।
(২) সমন জারি না হয়ে ফেরত আসার পর বাদী ৩ মাস পর্যন্ত নতুন করে সমন দেয়ার আবেদন না করলে; যথা সময়ে সমন জারি হয়ে এসেছে প্রমাণ হলে এবং বাদী হাজির থাকলে এবং বিবাদী হাজির থাকে কিন্তু বাদী অনুপস্থিত থাকলে দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ৯ বিধি অনুযায়ী ছানি মামলা করা যায়।
(৩) কোনো সন্তোষজনক কারণ ছাড়াই আদালতের নির্দেশিত ব্যক্তি আদালতে উপস্থিত না হলে; দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ৯ আদেশের ১৩ বিধি মতে ছানি মামলা করা যায়।
(৪) নির্ধারিত তারিখে শুনানি মুলতবি হয়ে থাকলে পরবর্তী তারিখে আপিল শুনানির জন্য ডাক পড়লে আপিলকারী হাজির না থাকলে; আপিল শুনানির ধার্য তারিখে বা শুনানি মুলতবি তারিখে প্রতিপক্ষ হাজির না থাকলে; আপিলকারী প্রতিপক্ষের ওপর নোটিস জারি করার জন্য আদালত কর্তৃক নির্ধারিত অর্থ আদালতে জমা না দিলে; দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ৪১ আদেশের ১৯ ও ২১ বিধিতে ছানি মোকদ্দমা করা যায়।
মামলা পুনরুজ্জীবিত করার বেশ কিছু বিধানঃ দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ ৯, বিধি ৪; আদেশ ৯, বিধি ৯ ও ৯ক এবং আদেশ ৯ বিধি ১৩ এর বিধান মতে মামলা পুনরুজ্জীবিত করার বিধান রয়েছে।
একতরফা ডিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিকারঃ কোনো মামলা বিবাদীর বিরুদ্ধে একতরফা ডিক্রি দেয়া হলে ইহা রদের জন্য বিবাদী ডিক্রিদান কারি আদালতে আবেদন করতে পারবে। এইক্ষেত্রে বিবাদী যদি কোনো সন্তোষজনক প্রমাণ দিতে পারে যে, তার উপর যথারীতি সমন জারি হয় নাই, বা অপর কোনো যথেষ্ট কারণে সে মামলার শুনানির সময় হাজির হতে পারে নাই, তবে আদালত বাদীর খরচ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে উক্ত একতরফা ডিক্রি রদের আদেশ দান করবেন এবং মূল মামলা বিচারের জন্য একটি তারিখ নির্ধারন করবেন।
একতরফা ডিক্রি যদি এমন হয় যে, উহা কেবল আবেদনকারি বিবাদীর উপর হতে রদ করা সম্ভব নয়, তবে সেক্ষেত্রে অন্যান্য সকল বা যেকোনো বিবাদীর উপর হতেও ইহা রদ করা যাবে। অপরপক্ষকে নোটিশ না দিয়ে একতরফা ডিক্রি রদের আবেদন বিবেচনা করা যাবে না। অর্থাৎ এই ধরনের ডিক্রি রদের আবেদন হলে অপর পক্ষকে অবশ্যই সে বিষয়ে নোটিশ দিয়ে এবং অপর পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকলে তা শুনে একতরফা ডিক্রি রদ বিষয়ে যথাবিহিত আদেশ দিতে হবে।
একতরফা ডিক্রি রদের এটাই একমাত্র বিধান নহে। উপযুক্ত কারণ থাকলে আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিবাদী ইচ্ছা করলে উচ্চাদালতে একতরফা ডিক্রি রদের জন্য আপীল করতে পারবে। একতরফা ডিক্রির জন্য বাদীর দাবির সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন হয় না সত্য, কিন্তু দাবির সমর্থনে প্রাথমিক প্রমাণ আবশ্যক। তবে একতরফা বিচারকার্য প্রত্যেক বিচারককেই দেখা উচিত যে, বাদীর মামলার সত্যতা প্রতিপন্ন করে না। কোনো তথ্য প্রমাণ ব্যতীত অাদালত একতরফা মামলার রায় ঘোষনা করতে পারবেন না। সেই প্রমাণগুলি বাদী দ্বারা প্রদত্ত হতে হবে।
লেখক: আইনজীবী
Discussion about this post