এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
রুমি ও সুমি। এক নবদম্পতি। সুখের সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর। হঠাৎ তাদের জীবনে নেমে আসে এক কালো রাত। এ নবদম্পতির ওপর দুর্বৃত্তদের নিক্ষেপিত এসিড যেন সবকিছু তছনছ করে দেয়। এসিড নিক্ষেপের বিচারপ্রার্থী হওয়ায় তাদের পরিবারের উপরও নেমে আসে এক অমানিষা কালো আঁধার। অশান্তি, ধিক্কার আর অপরাধী চক্রের কালো থাবা যেন তাদের গ্রাস করে দেয় সবকিছু। ঢাকার বনানীতে অবস্থিত এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছে যেনো এ দম্পতি।
সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রকাশ এসিড সন্ত্রাস, যা কেবল একজন মানুষের জীবনকেই থামিয়ে দিচ্ছে না, সভ্যতার দীপ্ত দুপুরে নামিয়ে আনছে মধ্যযুগীয় অন্ধকার। দেশজুড়ে এসিড সন্ত্রাসবিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও এসিডের ভয়াবহতা থেকে নারীকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। যতদূর জানা যায়, ১৯৬৭ সালে দেশে প্রথম এসিড নিক্ষেপের বর্বর ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় অতিক্রম করে সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে গেছে ইতিহাস, কিন্তু আলোকিত হয়নি মানবীয় সত্তা।
এসিড সন্ত্রাসের শিকার গল্পের সুমির আবেগঘন উক্তি, ‘পুরুষরা পরিকল্পিতভাবে এসিড নিক্ষেপ করে আমাদের গুরুতর আহত করছে এবং আমাদের চেহারা বীভৎস করে দিচ্ছে। তারা এসিড নিক্ষেপ করছে আমাদের শরীরে, পুড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মুখমণ্ডল, চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের নাক, গলিয়ে দিচ্ছে আমাদের চোখ, তারপর সুখী মানুষের মতো হেঁটে চলে যাচ্ছে ওরা।’
সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে যে, সারা দেশে মোট ১৪৫ জন এসিডদগ্ধের ক্ষেত্রে ৭ জনকে এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে যৌতুকের কারণে, ১০ জনকে পারিবারিক বিরোধের কারণে, টাকা-পয়সা নিয়ে বিরোধের কারণে নিক্ষেপ করা হয়েছে ৬২ জনকে, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ১৪ জনকে, প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯ জনকে এবং ২২ জনের ক্ষেত্রে কোনো কারণ জানা যায়নি। এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা একদিকে যেমন আমাদের মানবিক বিপর্যয়কে নির্দেশ করে, অন্যদিকে এর বিচার না হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইনের শাসন। ফলে মানবিকতাবোধ এবং সামাজিক মূল্যবোধ দুয়েরই বিনাশ ঘটছে। বর্তমান সময়ে আমরা যে উন্নয়ন আর আশার কথা বলি, তার সবকিছু মলিন হয়ে যাবে যদি এসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা না যায়। তাই এখনই এ বর্বরতম সন্ত্রাস প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সবাইকে।
আইনজ্ঞদের মতে, দেশে এসিড নিক্ষেপের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয় না। আইনি জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঝুলে থাকে বিচারকাজ। তথ্য-প্রমাণের অভাব এবং আইনের নানা ফাঁকফোকরে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যায়। এসিডদগ্ধদের বেশিরভাগই খুব গরিব হওয়ায় আসামিদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মামলা চালানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে বহু মামলার অকাল মৃত্যু হয়। এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত এসিড সহিংসতার মতো অপরাধের মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা দেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে। এএসএফের নির্বাহী পরিচালক মুনিরা রহমান জানান, এসিড সন্ত্রাস বন্ধের জন্য দুটি শক্তিশালী আইন রয়েছে। আর মামলায় তথ্য-প্রমাণের জন্য এসিডদগ্ধদের শরীরে ক্ষত রয়েছে। সরকারের বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা কার্যক্রম রয়েছে। এতকিছু থাকার পরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। তিনি জানান, এএসএফের কাছে সারা দেশ থেকে যে তিন হাজার এসিডদগ্ধ ব্যক্তি এসেছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের বেলায় আইনি সেবা নিশ্চিত করা গেছে। সরকারের সহায়তা কার্যক্রমে এখনও এসিডদগ্ধ ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়নি। জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত দশ বছরে সারা দেশে এক হাজার ৪৯৬টি এসিড নিক্ষেপের মামলা হয়েছে, অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে ৮৯১টির আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৫৭৫টির। এসব মামলায় মাত্র ১৩ জনের মৃত্যুদ-, ৯৫ জনের যাবজ্জীবন আর অন্যান্য শাস্তি পেয়েছে ১৬৫ জন, যার মানে সাজা পেয়েছে মাত্র ২৭৩ জন। মামলায় এক হাজার ৪৮৮ আসামি খালাস পেয়েছে। এএসএফের দাবি, একই সময়কালে এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় এক হাজার ৫২৪টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ছিল চার হাজার ১৩৩ জন। মামলাগুলোর ৫৯৭টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে ৯১৪টি ঘটনার। ১৬৬টি মামলার অভিযুক্ত ২৭৪ আসামির সাজা হয়েছে। তাদের ১৩ জনকে মৃত্যুদ- এবং ৯৫ জনের যাবজ্জীবন হয়েছে। এ ছাড়া ৪৪২টি মামলার অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় এক হাজার ৪৯৭ আসামি খালাস পায়। মোট মামলার ৩০২টি বিচারাধীন এবং বর্তমানে তদন্ত চলছে ১৩টির।
বিপুলসংখ্যক অভিযুক্ত সাজা না পাওয়ার কারণ হিসেবে এসিড মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে আইনি সহায়তাকারী আইনজীবীরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। তাদের মতে, আলামত জব্দের সঙ্গে মামলার বিবরণীর মিল থাকে না, সাক্ষী হাজির করার সমস্যা, ভিকটিমের (এসিড সন্ত্রাসের শিকার) যথাযথ মেডিকেল পরীক্ষা না হওয়া, আইন সম্পর্কে এফআইআর লেখক এবং ভিকটিমের অজ্ঞতাসহ নানা বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা এক্ষেত্রে রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসিড আক্রান্তদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা পুলিশের অদক্ষতা ও অসাধুতা। অনুসন্ধান এবং আক্রান্তদের পরিবার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমত, পুলিশ অভিযুক্ত অপরাধী বা দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে না। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তি যেসব অপরাধী সম্পর্কে অভিযোগ করেন, পুলিশ সেসব অভিযুক্তকে না ধরে অন্যদের ধরে। এ ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামে এবং রাতের বেলায় ঘটে থাকে। গ্রামের মানুষ আইন সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় ঠিকমতো কেস ফাইল করতে পারেন না। পুলিশ এ মামলাগুলো এসিড মামলা করে দেয়। কখনও কখনও পারিবারিক বিরোধ, সম্পত্তি বা পূর্বশত্রুতার জের হিসেবে আসামিকে না দেখেই ভিকটিম অনেকের নামে মামলা করেন। সঠিক আসামি শনাক্ত না হওয়া এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে যায়। অনেক সময় আসামিকে চিনতে না পারলেও ভয়ভীতির কারণে বা প্রলোভনে এবং প্রভাবশালীদের চাপে ভিকটিম মুখ খোলে না।
এসিড সহিংসতা বন্ধে ২০০২ সালে ‘এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন’ এবং ‘এসিড অপরাধ দমন আইন’ প্রণীত হয়। এ বিলে এসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- এবং পৃথক ট্রাইব্যুনালে ৩০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। এসিড নিক্ষেপ একটি অজামিনযোগ্য অপরাধ এবং এসিড নিক্ষেপের ফলে ক্ষতিগ্রস্তকে অর্থদণ্ডের অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই বিলে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এসিড দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এসিড দ্বারা আহত করার শাস্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে
(ক) যদি কোনো ব্যক্তি এসিড দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে আহত করে, যার ফলে তার দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নষ্ট হয় বা মুখমণ্ডল, স্তন বা যৌনাঙ্গ বিকৃত বা নষ্ট হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এর অতিরিক্ত এক লাখ টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
(খ) এসিড নিক্ষেপের ফলে যদি কেউ শরীরের কোনো অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃতি বা নষ্ট বা কোনো স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হন তাহলে এসিড নিক্ষেপকারীর ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
এসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা করার শাস্তি :
যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর এসিড নিক্ষেপ করে বা নিক্ষেপের চেষ্টা করে এবং এর ফলে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতি নাও হয়, তথাপি অপরাধীর অনধিক সাত বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদ- হতে পারে। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও হতে পারে।
সহায়তাকারীর শাস্তি :
এসিড অপরাধ দমন আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটনে কাউকে সহায়তা করে এবং এই সহায়তার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হয় অথবা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে অপরাধ সংঘটনের জন্য বা চেষ্টা করার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে সহায়তাকারীও দণ্ডিত হবে।
কিন্তু কাজীর গরু যেমন কেতাবে থাকে, তেমনি এ আইনেরও কোনো প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরা পড়ছে না, আর ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিচারের সময় সঠিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হচ্ছে না, এমনকি এসিড সন্ত্রাসকে অনেক সময় ‘আগুনে পোড়া’ বলেও চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
২০০৪ সালের ২৭ জুলাই এসিড আমদানি, উৎপাদন, মজুদ, পরিবহন, বেচাকেনা ও ব্যবহারের ওপর কঠোর আইন করা হয়। এতে এসিড ব্যবসায়ী বা ব্যবহারকারীর জন্য লাইসেন্সে বাধ্যতামূলক করা হয়। লাইসেন্সের শর্তাবলিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কেবল অনুমোদিত পরিমাণ এসিড সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারবে। লাইসেন্স বর্ণিত উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কাজে তা ব্যবহারও করা যাবে না। এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৩৬-এ বলা হয়েছে, লাইসেন্সবিহীন এসিড বিক্রি ও ব্যবহারকারীকে অনূর্ধ্ব ১০ বছর; কিন্তু অন্যূন ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। কিন্তু তার কতটুকু বাস্তব প্রয়োগ আছে, পাঠকই ভালো জানেন। নব দম্পতি রুমি ও সুমির জীবনেও এমনটিই ঘটেছে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’।
Discussion about this post