সিরাজ প্রামাণিক
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।
দোষস্বীকারোক্তি একটি ভয়ঙ্কর শব্দ, যদি তা হয় ভীতিপ্রদর্শণপূর্বক। একটি দেশে, একটি সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আইন সম্পর্কে সচেতনতা। যে সমাজে আইনের শাসন নেই, সে সমাজ সভ্য বলে বিবেচিত নয়। একটি সচেতন জনগোষ্ঠীই পারে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এখানে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার তথা মানবাধিকার-এ ধারণাগুলো প্রকৃতরুপে বিকশিত হতে পারেনি। এ বাস্তবতার নিরিখেই ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে আমার এ লেখা। একটি কৌতুক দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর বৃটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষনের একটি অংশ ছিল আমাজান বনে। এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় যে, এ বাচ্চা গুলোকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় দেয়া হবে একদিন। তবে এর বেশী সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবেনা। সুইজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন। ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। বৃটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোন খোঁজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। একমাস পর ব্রজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরে ফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দেন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটা হরিণের বাচ্চা।
দোষ স্বীকারোক্তি বলতে অপরাধকারী কর্তৃক স্বেচ্ছায় প্রণোদিতভাবে নিজের অপরাধের স্বীকার করাকে বোঝায়। দেশে প্রচলিত কোনো আইন দ্বারা যে কর্মকে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এরূপ অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি যদি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে বিনা প্ররোচনায়, কোনোরূপ প্রলোভন ছাড়া নির্ভয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য পেশ করেন তাকে স্বীকারোক্তি বলে।
স্বীকারোক্তি লিখে রাখার সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এটা স্বেচ্ছামূলক। শুধু অপরাধীর বক্তব্যই নয় বরং তার আচরণের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। দোষ স্বীকারোক্তি লেখার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা, ৩৬৪ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ২৪ থেকে ৩০ ধারা ও হাইকোর্ট জেনারেল রুলস অ্যান্ড সার্কুলার অর্ডারসের (ক্রিমিনাল) ২৩ ও ২৪ নং রুলস প্রযোজ্য। এ বিধানগুলোর মধ্যে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায়ই দোষ স্বীকারোক্তি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে। স্বীকারোক্তি লেখার শেষে স্বীকারোক্তির নিম্নে তিনি একটি প্রত্যয়নপত্র দেবেন।
“আমি (নাম) এর নিকট ব্যাখ্যা করেছি যে, তিনি স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং যদি তিনি স্বীকারোক্তি করেন, তাহলে উক্ত স্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, এ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দেয়া হয়েছে। এ স্বীকারোক্তি আমার উপস্থিতিতে এবং আমার শ্রুতি গোচরে গৃহীত হয়েছে। এটা স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তিকে পড়ে শোনানো হয়েছে এবং তিনি তা সঠিক বলে স্বীকার করেছেন এবং এ লিখিত স্বীকারোক্তিতে তার প্রদত্ত বিবৃতির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বিবরণ রয়েছে।”
আসামির স্বীকারোক্তি রেকর্ডের ক্ষেত্রে তার শপথ গ্রহণের কোনো আইনগত বিধান নেই। কোনো অপরাধজনক ঘটনার পুলিশি তদন্ত চলাকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বীকারোক্তির জন্য নিয়ে আসলে বা উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আসলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে ওই ব্যক্তিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানবেন উক্ত ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ইচ্ছুক কি-না? পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হলে অভিযুক্তকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে কখন, কোথায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং কোথা থেকে সে পুলিশের হেফাজতে আছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে আগ্রহী তাহলে তাকে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার জন্য যুক্তিযুক্ত সময় প্রদান করবেন। সাধারণত ন্যূনতম তিন ঘণ্টা সময় দেয়ার প্রচলন রয়েছে। এ সময়ে উক্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবেন। এ সময় উক্ত ব্যক্তিকে পুলিশের সঙ্গে বা অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ বা পরামর্শ করার সুযোগ দেয়া যাবে না এবং এ সময়ে তিনি যাতে কারো দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত না হতে পারেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যুক্তিযুক্ত সময় শেষে উক্ত ব্যক্তি যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বিবেকের তাড়নায় পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়েও স্বীকারোক্তি করছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন করবেন এবং তার উত্তর লিখে রাখবেন। এরপর ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৪ ধারা অনুসরণে উক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি লিখে তা তাকে পড়ে শোনাবেন। পড়ে শোনানোর পর উক্ত ব্যক্তি তা সঠিকভাবে লেখা হয়েছে বলে স্বীকার করলে তাতে তার স্বাক্ষর নেবেন এবং ১৬৪ ধারার বিধান মতে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাতে স্বাক্ষর করবেন। লিখিত স্বীকারোক্তি পড়ে শোনানোর পর যদি স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তি তাতে কোনো সংশোধনের কথা বলেন তবে তা সেভাবে সংশোধন করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, স্বীকারোক্তি প্রদানকালীন সময়ের যে কোনো পর্যায়ে স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেয়ার ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তন করে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানালে উক্ত স্বীকারোক্তি আর লেখা যাবে না বা স্বীকারোক্তি দিতে তাকে আর বাধ্য করা যাবে না। এমনকি স্বীকারোক্তি লেখার পরও যদি উক্ত ব্যক্তি তাতে স্বাক্ষর করতে রাজি না হন তবে তাকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা যাবে না এবং এ ক্ষেত্রে তার এটি স্বীকারোক্তি হিসেবেও গণ্য করা যাবে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্বীকারোক্তি গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব সম্পর্কে যে বিষয়গুলো অবগত হলাম, সেগুলো নি¤œরুপঃ
ক. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোনো পুলিশের সামনে রেকর্ড করা যাবে না, এটা অবশ্যই শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে রেকর্ড হবে, এমনকি এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষেও কোনো পুলিশ উপস্থিত থাকতে পারবে না।
খ. ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারা মোতাবেক, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে তিনি অবশ্যই জবানবন্দিদাতাকে এটা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে, এই জবানবন্দি প্রদান করতে তিনি কোনোভাবে বাধ্য নন এবং তাঁকে এ-ও পরিষ্কার করে বলতে হবে যে, যদি এ ধরনের কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাহলে এটা তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।
গ. সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দিদাতাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এই জবানবন্দিদাতা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং কোনো প্রকার প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করছেন।
ঘ. ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড ও স্বাক্ষর করার যে পদ্ধতি বলা হয়েছে, সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দিদাতার স্বাক্ষর নেবেন এবং স্বাক্ষর নেওয়ার আগে তিনি কী জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তাঁকে অবশ্যই পড়ে শোনাবেন।
ঙ. এবং সর্বশেষ তিনি স্বীকারোক্তির শেষে সব কিছু উল্লেখ করবেন, অর্থাৎ আইন দ্বারা আরোপিত দায়িত্বগুলো তিনি কিভাবে পালন করেছেন এবং তিনি কিভাবে আশ্বস্ত হয়েছেন যে এই জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি জবানবন্দি দেওয়ার ফলাফল সম্পর্কে ব্যক্তিটিকে অবহিত করেছেন কি-না ইত্যাদি উল্লেখ করে একটি মেমোরেন্ডাম লিখবেন, যেটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির একেবারে শেষে থাকবে এবং ওই মেমোরেন্ডামের নিচে তিনি স্বাক্ষর করবেন।
এ ছাড়াও ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর স্ব-বিবেচনা প্রয়োগ করে আসামিকে আরো কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন-
১) আপনি পুলিশের হেফাজতে কত দিন ছিলেন?
২) পুলিশ কি দোষ স্বীকার করার জন্য নির্যাতন করেছে?
৩) দোষ স্বীকারের জন্য আপনার ওপর কোনরুপ চাপ রয়েছে কী?
৪) আপনাকে কি শাসানো বা প্রলোভন দেখানো হয়েছে কি?
৫) আপনাকে রাজসাক্ষী করার কেউ প্রস্তাব দিয়েছে কি?
৬) কেন আপনি দোষ স্বীকার করছেন?
উল্লিখিত আইনের বিধি-বিধানগুলো পালন করার পর কেউ যদি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন, তখন তা আইনের দৃষ্টিতে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী প্রমাণ হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু বাস্তবে এ বিধানগুলো কতটা মানা হয়, তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
সুতরাং হেফাজতের তোড়ে কোনো আসামি যেসব স্বীকারোক্তি দেয় সেগুলোর আইনগত ভিত্তি নেই। আদালতে সেগুলো সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে এ ধরনের স্বীকারোক্তির অর্থ কী? অর্থাৎ নির্যাতনই সার কথা। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেও না জানার কথা নয় হেফাজতকালে পুলিশ গ্রেফতারকৃতকে কী করে, তার সঙ্গে কী আচরণ করে। পুলিশী হেফাজতের প্রায়ই মানুষ মরছে। মৃত্যুগুলোর খবর নিশ্চয়ই প্রজা থেকে রাজারা জানছেন।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘পুলিশের হেফাজতে আর একটি মৃত্যুও নয়।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।
Discussion about this post