ড. বদরুল হাসান কচি
বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক মহিমান্বিত ভাষা। বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা। অথচ এ ভাষার ব্যবহার নেই উচ্চ আদালতে। ভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পরেও বাংলা ভাষা উচ্চ আদালতে উপেক্ষিত। বাংলা ভাষা ব্যবহারে আইনগত কোনো বাধা নেই। সংবিধানেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা। অথচ ভাষা নিয়ে যে দেশে এত কিছু ঘটেছে, সে দেশের আদালতে বাংলা চালু করা যায়নি।
১৯৮৭ সালে প্রণীত হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে ৩ (১) আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) (১) উপধারায় উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হইবে। (৩) যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি এ আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে ওই কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলে গণ্য হবেন এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও আদালত এ বাধ্যবাধকতার বাইরে রয়েছেন। এ প্রশ্নে বেশ কিছু দেওয়ানি বিষয়ের আবেদনপত্র নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ১৯৯১ সালের ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট একটি রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারার ১ উপধারা মতে, আদালতে ইংরেজির ব্যবহার, যথা রায়, আরজি, সওয়াল-জবাব ইত্যাদি লেখা হলে তা বেআইনি হবে না। কাজেই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণীত হওয়ার আগে আদালতে যেমন ইংরেজি ভাষায় আরজি, সওয়াল-জবাব, দরখাস্ত, রায় লেখা হত- তেমনটি চলতে পারে। ওই রায়ে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। বলা হয়, ভাষার তিনটি ব্যবহার। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রভাষা, সরকারের ভাষা ও আদালতের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার অর্থ, যে ভাষা রাষ্ট্রের সব কাজে ব্যবহৃত হয়। সরকারের ভাষা হল নির্বাহী কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা। আদালতের ভাষা বিচারিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা।
হাইকোর্টের এ রায়ের পর আর নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন কমিশনের সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু ঐ সুপারিশ উপেক্ষিত হয়ে এসেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আইন করে বাংলা চালু করা উচিত। ইংরেজিতে লেখা বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি উচ্চতর আদালতেও বাংলায় বিচারকার্য পরিচালনা ও রায় লেখা দরকার। সুপারিশে বলা হয়, যদিও ১৯৮৭ সনে আদালতে বিচারিক কাজসহ অন্যান্য আইনি কাজকর্মে বাধ্যতামূলক বাংলা ব্যবহারের জন্য “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন” করা হয়, তারপরও বিশেষত উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার নির্বিবাদে চলছে। আরও বলা হয়, রায় ইংরেজিতে লেখা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বৈষ্যমের শিকার হন। তারা ইংরেজি না বোঝার কারণে খুব বিপদের মধ্যে পড়েন। আদালতের ভাষা তাই গণমানুষের ভাষাকে অনুসরণ করা উচিত।
আদালতে যারা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেন তাদের মত হচ্ছে, মামলা রুজু করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নজির নিতে হলে ইংরেজি বই থেকে নিতে হয়। তাছাড়া ইংরেজি ভাষার বাংলা প্রতিশব্দের অভাব, বাংলা সাঁটলিপিকার ও মুদ্রণ সহকারীর অভাব রয়েছে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায় বিদেশের আদালতগুলোতে নজির হিসেবেও নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলায় লেখা থাকলে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।
গেল বছরের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাংলায় দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না।
উচ্চ আদালতে ইংরেজির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যারা ভারত বা পাকিস্তানের উদাহরণ টানেন তাদের জানা দরকার যে, বিভিন্ন ভাষাভাষীর দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানে জনগণের একক কোনো ভাষা নেই। তাদের সংবিধানে বহু ভাষার মধ্যে ইংরেজিকেই আদালতের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সংবিধানে ইংরেজিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি আমাদের সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলাকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ভারতের আদালতের বিচারকরা সারা ভারত থেকে আসেন। ২২টি সরকারি ভাষার দেশ ভারতে হিন্দির সঙ্গে সব বিচারক পরিচিত নন। কিন্তু আমাদের দেশের আমরা সবাই একই ভাষার। আমাদের দেশে আইনজীবী, বিচারপতি, বিচারপ্রার্থী প্রত্যেকেরই ভাষা বাংলা।
উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে রায় লেখার প্রথা সর্বপ্রথম ভেঙে ফেলেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। সেটা ১৯৮৯/৯০ সালের কথা। তারপর আরো দুইজন বিচারপতি দু-চারটি রায় দিয়েছেন বাংলা ভাষায়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আগের বিচারপতিদের উদ্যোগকে আরও টেনে নিয়ে যান সামনের দিকে। ২০০৭ সাল থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
আদালত সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জায়গা। সেখানে ভাষা হবে জনসাধারণের ভাষা যাতে বিচারপ্রার্থীরাই বেশি উপকৃত হন। আদালতে ইংরেজি ব্যবহারের ফলে বিচারপ্রার্থীরা তাদের তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, মামলার রায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন না। আবার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সব আইনজীবী বিশেষ করে অধস্তন আদালতে সবাই ইংরেজিতে দক্ষ নয়, তাদের ক্ষেত্রে ল রিপোর্ট থেকে কোন মামলার সিদ্ধান্ত জানা কিংবা মামলার বিস্তারিত ঘটনা বুঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়া গবেষণার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দটির সঠিক বাংলা কি হবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয় গবেষকদের মাঝে।
লেখক: আইনজীবী
Discussion about this post