মানব জীবনের অনেক গল্প থাকে। কিছু গল্পের অবতারণা হয়, যার কোনো সান্তনা থাকে না। মনে হতে থাকে এ সমস্যার নেই বুঝি কোনো সমাধান। পাঠক! আমি আপনার তেমনি একটি গল্প শোনাবো। কিন্তু গল্পের চরিত্র যদি আপনার দুঃখবোধকে উসকে দেয়; তাহলে ক্ষমা করে দেবেন।
একটি অভিজাত পরিবারের শিক্ষিতা মেয়ে খুশি (ছদ্মনাম)। মাঝারি গড়নের, চিকন ও ফরসা। ডাগর ডাগর দুটি চোখ জুড়ে যেন কিছু না পাওয়ার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ। হঠাৎ একদিন আমার চেম্বারে এসে হাজির। মোয়াক্কেল হিসেবে পরিচয় পর্বেই মেয়েটিকে অদ্ভূত প্রকৃতির মনে হলো। তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় নিয়ে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ছাড়ল। একটা মানুষ অজানা বিষয় জানতে চাইতে পারে। আইন বিষয়ে যেটুকু পড়াশোনা করেছি, জেনেছি, জানাতো তো অসুবিধা নেই! এই ভেবে আমি ধৈর্য ও আন্তরিকতা নিয়েই তার প্রশ্নগুলো শুনে, বুঝে উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম। পাঠক, আমি গল্পের শুন্ততেই বলেছি, মেয়েটি অভিজাত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষিতা মেয়ে। আইনের সামান্য ছোট-খাটো বিষয়ে মেয়েটির জ্ঞানের গভীরতা দেখে মনে হলো, এই যদি হয় একজন শিক্ষিত মেয়ের দশা, তাহলে এ দেশের মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, স্বল্প শিক্ষিত নারীদের জানার পরিধি কতটা!
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ আইনের স্বাভাবিক বিবর্তণ নিয়েও মাথা ঘামায় না। তারা মনে করে আইন, অপরাধ, শাস্তি ইত্যাদি আইনের ছাত্র, শিক্ষক ও বোদ্ধা আইনজীবীদেরই একান্ত জানা প্রয়োজন। অথচ জনগণের আইন সচেতনতা একটি মৌলিক প্রয়োজন। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের (প্রস্তাবনা-অনুচ্ছেদ ৪) এ ষ্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানকে রক্ষার, সমর্থণের ও নিরাপত্তা বিধানের একটি সাধারণ দায়িত্ব জনগণের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের আইনবিষয়ক সুষ্ঠু চিন্ত াভাবনা ও সচেতনতা থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু জাতীয় জীবনে আমাদের আইন ভাবনা খুব একটা ক্রিয়াশীল তো নয়ই, বরং বহুমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল।
পাঠক, আসল কথায় ফিরে আসি। মেয়েটি প্রথমে আমার কাছে জানতে চাইলো, ধরুন কেউ যদি শুধু কোর্ট ম্যারেজ করে, কিন্তু কাবিননামাটি সম্পন্ন না করে সংসার করতে থাকে, তাহলে বিয়ের বৈধতা কতটুকু? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে যা বলতে হলো তা নিম্নরুপঃ
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজের কোন বৈধতা নেই, এমনকি এর কোন অস্তিত্বও নেই। ৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা ১৫০/-টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্যালয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী কাবিন রেজিষ্ট্রী সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে। মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ বিধি ১৯৭৫ এর ১৯(৩) ধারা অনুযায়ী ‘নিকাহ রেজিষ্ট্রার ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি যদি বিবাহ করান তাহলে সেই ব্যক্তি ১৫ দিনের মধ্যে ওই নিকাহ রেজিষ্ট্রারের নিকট অবহিত করবেন, যার এলাকায় উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।’ মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৪-এর ধারা ৫(২) অনুযায়ী বিবাহ রেজিষ্ট্রশন না করার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদন্ড কিংবা ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।
বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়ে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সম্বন্ধে আইনগত দলিল যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিষ্ট্রী করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। লাইসেন্সবিহীন কাজীর নিকট বিয়ে রেজিষ্ট্রী করলে এর কোন আইনগত মূল্য নেই। কাজীর কাছে গিয়ে কাবিন না করলে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কাবিননামা না থাকায় নারীরা তাদের মোহরানাও পায় না। আইনানুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিষ্ট্রিী করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রী করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রী করা যায়। এছাড়াও কাবিননামার সকল কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্যন্যা ব্যক্তিগণের স্বাক্ষর দিতে হয়।
উপরের গল্প ও প্রশ্নোত্তর শুনে মেয়েটি বলল, আমি আমার স্বামীকে ভালবেসে কোর্ট ম্যারেজ করেছিলাম। ওর ঔরষে আমার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। কিন্তু আমি ওকে তালাক দিতে চাই। আমি মেয়েটিকে বললাম ‘দেখুন, কাবিননামা ছাড়া তালাকের রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। কার্যকর করা যায় না। এক অর্থে আপনার বিয়েটার আইনগত ভিত্তি নেই। তবু একত্রে যেহেতু সংসার করেছেন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে, ধরে নেওয়া যেতে পারে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী বিয়েটা হয়েছে। যেহেতু আপনি নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কোর্ট ম্যারেজ করেছেন, সেহেতু আপনি নোটারি পাবলিকের মতো হলফনামার মাধ্যমে তাঁকে তালাক দিতে পারেন। তবে আইনের ব্যাখ্যাটি নি¤œরুপঃ
স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোন এক পক্ষের সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অপরকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং যাকে তালাক দেয়া হচ্ছে উক্ত নোটিশের নকল তাকে প্রদান করতে হবে। চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ হবে না। নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে উল্লেখিত সময় অথবা গর্ভাবস্থা-এ দুইটির মধ্যে দীর্ঘতরটি অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না। যে কোন ধরণের তালাক রেজিষ্টেশনের ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবকে ২০০ (দুই শত) টাকা ফি প্রদান করে তালাক রেজিষ্ট্রি করতে হবে। (১৯৯৯ সালের ২৯শে আগষ্ট তারিখের গেজেট নোটিফিকেশন)। ১৯৩৯ সালের মুুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে। কারনগুলো হলো
১. চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
২. দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে।
৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদন্ড হলে।
৪. স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
৬. স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সর্ম্পক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে।
৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লংঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
উপরে যে কোন এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে।
১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশকে তালাক সংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হবে।
তালাক বিষয়ে উপরোক্ত আইনগত ব্যাখ্যার পর মেয়েটির এবারের প্রশ্ন, আমার মেয়েটি আমার সাথে থাকতে পারবে কি
না? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাকে যা বলতে হলো তা নিম্নরুপঃ
মুসলিম আইন ও রাষ্টীয় আইন অনুসারে পিতাই সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক। তাই সন্তানের ভরণপোষণের সমস্ত দায়-দায়িত্ব হচ্ছে বাবার।
ক) সাবালক প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পিতা তার ছেলে-মেয়েদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
খ) তালাক বা বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে, তবুও বাবাই ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে ছেলে ৭ বৎসর এবং মেয়ের বিবাহ হওয়া পর্যন্ত । উল্লেখ্য যে, মেয়ের বিয়ের খরচও বাবাকেই দিতে হবে।
গ) যদি কোন সাবালক সন্তান অসুস্থতার জন্য কিংবা পঙ্গুত্বের জন্য রোজগার করতে না পারে, তবে বাবা তাকে আজীবন ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
ঘ) পিতা-মাতা গরীব বা দৈহিকভাবে অসমর্থ হলে দাদার অবস্থা সচ্ছল হলে ওই সকল ছেলে-মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব দাদার উপর ন্যস্ত হবে।
ঙ) সন্তানদের অভিভাবক বাবা, মা সন্তানের জিম্মাদার ও হেফাজতকারী হিসাবে ভুমিকা পালন করবে।
চ) মা সন্তানের লালন পালনকারী। মায়ের দায়িত্ব সন্তানদের দেখাশুনা করা। সন্তানেরা মায়ের কাছে থাকবে এবং বাবা সমস্ত খরচ বহন করবে।
ছ) মুসলিম আইনে বাবা তার দায়িত্ব পালন না করলে অভিভাবকত্বের দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরও সন্তানেরা মায়ের কাছে থাকতে পারবে।
মা কখন সন্তানের জিম্মাদার থাকতে পারবে না
১. মা অসৎ জীবন যাপন করলে।
২. মা এমন কাউকে বিয়ে করলে যার সঙ্গে তার নিজের কন্যার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় নিষেধ নেই।
৩. সন্ত ানের প্রতি উদাসীন, দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে।
পাঠক, গল্পের মেয়েটি তার আট বছরের সংসার জীবনের ইতি টানলেন স্বামীকে পুন্তষত্বহীন বলে আখ্যা দিয়ে। এরপর বেশ কিছুদিন পরে আসলেন আমার চেম্বারে। পরিচয় করিয়ে দিলেন একটি স্মার্ট ছেলের সাথে। বললেন, ‘ভাইয়া, ছেলেটি অনেক ভালো মানুষ। আমার সব কথা জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি ওর মধ্যে আমার না-পাওয়া অতীতগুলো খুঁজে পেয়েছি। ওকে ভালোবেসেছি নিঃসংকোচে। দয়া করে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজন নিকাহ রেজিষ্টার কাজীকে ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কী অদ্ভুত মানুষের জীবন-যৌবন-সম্পর্ক। কী অদ্ভূত মানুষের চেতনা-চৈতন্য। বিদায় মূহুর্তে মেয়েটিকে অভিনন্দন জানালাম। বললাম, ভালো থাকুন খুশি, সারাটি জীবন—।
লেখকঃ আইনগ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সময়ের দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক। মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮.
Discussion about this post