একজন আইনবিদ যদি বিচার বিবেচনা না করে তাঁর মক্কেলকে ভুল পথে চালান, তবে তিনি নৈতিকতা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন এবং এ কারনে তিনি আইন পেশার অধিকার হারাতে পারেন। ঠিক তেমনি আদালত অবমাননা কখন, কীভাবে হতে পারে সে বিষয়ে প্রত্যেকের বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িতদের পরিষ্কার ধারণা থাকা অপরিহার্য। যদি সঠিক ধারণা থাকে, তবে আমাদের আদালত অবমাননা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখি যেমন হতে হয় না, ঠিক তেমনি মহামান্য আদালত ও বিচারক মহোদয়কেও বিব্রত হতে হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও আদালত অবমাননার বিষয় দুটো বেশ স্পর্শকাতর। পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে স্মরণে রাখা দরকার যে, স্বাধীনতারও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা ইচ্ছে তা করা বা লেখা। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা, সেদিক বিবেচনায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আমাদের উচিত বিচার বিভাগ ও আদালত সম্পর্কে তথ্য পরিবেশনের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। মূলত, সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে বলা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় সব নাগরিকের বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হলো। বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবিদার; কেননা উল্লিখিত অনুচ্ছেদে সংবাদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা যেসব শর্ত সাপেক্ষে করা হয়েছে তার মধ্যে আদালত অবমাননা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিধান মোতাবেক আদালত অবমাননা দুটি শ্রেণীতে পড়তে পারে, যথা দেওয়ানি আদালত অবমাননা ও ফৌজদারি আদালত অবমাননা। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দেওয়ানি আদালতের দেয়া রায়ে ডিক্রি, আদেশ, রিট অথবা আদালতের পরোয়ানা অমান্য কিংবা আদালতের দেয়া কোনো রায় বা মুচলেকা ভঙ্গ করে থাকেন তবে সেটা আদালত অবমাননা হতে পারে।
দেওয়ানি বিচারিক বিষয়টি নিয়ে আদালত অবমাননা সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত না হলেও ফৌজদারি আদালত অবমাননার বিষয়টি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত। বেশকিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যদি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় তবে সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার বিষয়টি বিবেচনায় আসে। ২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি বিধির কন্টেম্পট পিটিশন নং ৯৫৭১/২০০৭ (রাষ্ট্র বনাম আদালত অবমাননাকারী) মামলায় স্বয়ং মহামান্য বিচারপতি আদালত অবমাননা সম্পর্কে রায় প্রদান করতে গিয়ে উল্লেখ করে বলেছেন, বিচারকরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় তবে সে সমালোচনা সংযত ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া দরকার। একজন বিচারকের রায় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে আইনগত কোনো প্রকারের বাধা নেই। কিন্তু প্রদত্ত সে রায়ের কারণে বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করা যাবে না। প্রত্যেকের বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় আইন বিচারকদের এতটুকু নিরাপত্তা জনগণ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে প্রদান করেছেন। যদি সে রকমটা না হতো তবে বিচারকের মতো সর্বাধিক গুরুদায়িত্ব পালন করতে কেউ রাজি হতেন না।
বিচারকরা যে সমালোচনার ঊর্ধ্বে তা কখনও নয় তবে তার দায়বদ্ধতা বা সে সব সমালোচনার ধরন ও প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা। বিচারকের রায়ে যদি কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হয় এবং সে যদি মনে করে তবে সে ন্যায়বিচারের প্রাপ্তির জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে। কাজেই আমাদের উচিত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভুলে গেলে চলবে না একজন বিচারক যদি তার বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে নির্ভীক না হতে পারেন ও প্রদত্ত রায় সম্পর্কে যদি উদ্বিগ্ন থাকেন বা প্রচারিত কোনো সংবাদ সম্পর্কে ভীত হয়ে যান তাহলে তিনি ন্যায়বিচার কিংবা স্বাধীনভাবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতে পারেন। যদি সে রকমটা হতে থাকে তবে পরিশেষে বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে দেশবাসী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচারপতিদের সাহস থাকতে হবে, তবেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পাবে। পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
আঠারো শতকের প্রথম ভাগে মহামান্য বিচারপতি খড়ৎফ জড়নবৎঃংড়হ বলেছিলেন রহ ঃযব ধনংবহপব ড়ভ রসসঁহরঃু, হড় সধহ নঁঃ ধ নবমমধৎ ড়ৎ ধ ভড়ড়ষ ড়িঁষফ নব ধ লঁফমব. কাজেই প্রচলিত আইন ও আদালতকে সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের দায়িত্ব।
আমাদের যে বিষয়টার দিকে অধিকতর মনোযোগ প্রদান করা দরকার তা হলো সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন আদালত অবমাননার বিচারকালে সে বিষয়টি আদালত কখনও বিবেচনায় আনে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ যখন আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রচলিত সব আইনের আদালতে বিচারের স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করে তখন আদালত অবমাননা পূর্ণতা লাভ করে। প্রকাশিত সংবাদটি সত্যি আদালত অবমাননার দায়ে পড়ে কিনা সে বিষয়টি নির্ধারণ করার জন্য যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো : ১. সংবাদটি অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে; ২. সংবাদপত্রের উল্লিখিত প্রকাশনাটি বিচারাধীন মামলায় ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টির জন্য; ৩. প্রকাশনাটি বিচারের স্বাভাবিক গতিতে হস্তক্ষেপ অথবা জনমনে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টির উদ্দ্যেশে; ৪. মামলাটি বিচারাধীন বা বিচার আসন্ন এ সম্পর্কে প্রকাশনা কালে পত্রিকাটির পরিপূর্ণ জ্ঞান ছিল কিনা? উপরে উল্লিখিত শর্তগুলো সঠিকভাবে পূরণ করা বা না করার ওপর নির্ভর করে আদালত অবমাননা হবে কি হবে না।
১৯৯৩ সালে সলিম উল্লাহ বনাম রাষ্ট্র মামলায় আদালত বলেছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হলে তাঁকে তা মেনে নিতে হবে। [সূত্র: ৪৪ ডিএলআর (এডি) (১৯৯২) ৩০৯]। সংবিধানের ৩৯ (২) (খ) অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দানের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। তাই গণমাধ্যম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের এই ধারা সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকবেন।
বিচারকদের দায়িত্ব কোনো মামুলি দায়িত্ব নয় বরং গুরু দায়িত্ব। বিচারকের কাজের সঙ্গে চিকিৎসকের কাজের তুলনা করলে ভুল হবে না। ২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট আদালত অবমাননা আইনের মামলায় রায় প্রদানকালে মন্তব্য প্রদানকালে বলেন, প্রতিটি চিকিৎসক জীবন্ত মানুষের হৃদয়ে, মস্তকে বা শরীরের অন্যান্য বিশেষ অপরিহার্য ও সংবেদনশীল অঙ্গে অপারেশন করার সময় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু অপারেশনে নিয়োজিত করে থাকেন। কেননা তিনি জানেন তার মনোযোগের সমান্যতম বিঘœ ঘটলে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। যদি কোনো কারণে সে চিকিৎসক সমালোচনার সম্মুখীন হন কিংবা ভীত হয়ে যান তবে তার পক্ষে যেমন অপারেশন করা দুরূহ হয়ে পড়বে ঠিক তেমনি বিজ্ঞ বিচারকরা যদি সমালোচনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন তবে তা হলে বিচারকার্য অবিচারে পর্যবসিত হতে পারে। ফলাফল হিসেবে বিচারক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুদূর প্রসারিভাবে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম ক্ষতির স্বীকার হতে পারেন। সে দিক বিবেচনায় কোনো বিচারক সম্পর্কে কোনো প্রকারের অভিযোগ সৃষ্টি হলে প্রথমে তাকে সে অভিযোগ সম্পর্কে জ্ঞাত করা অপরিহার্য। পরবর্তী সময়ে তার ঊর্ধ্বতন নিয়ন্ত্রণকারী মহামান্য বিচারক মহোদয়কে বিষয়টি জ্ঞাত করা দরকার। যদি প্রয়োজন হয় তবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির গোচরীভূত করা যেতে পারে। কারণ, কোনো অসৎ বিচারককে কোনো পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগে নিয়োজিত রাখা উচিত নয়।
১৯৮৫ সালে হাইকোর্ট অব কেরেলা বনাম প্রিতিশ নন্দি (ক্রিলজা-১০৬৩) মামলায় মহামান্য বিচারপতি বলেন, বিচারকের বদান্যতা এতখানি পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না যে, সে কথা ও কার্যকে উৎসাহিত করবে যা জনসাধারণের বিচার প্রণালীর প্রতি আস্থা নষ্ট করবে, কোনো রকমের অনুগ্রহ বা ভীতি ছাড়া তাদের দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে। মুক্ত সমালোচনায় সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও অর্পিত ভূমিকা রাষ্ট্রের স্বীকার করে নিতে হবে। মন্তব্য, সমালোচনা, তদন্ত ও গ্রহণের যুগে বিচার বিভাগ যৌক্তিক ও অনিষ্টবিহীন সমালোচনার হাত থেকে নিরঙ্কুশভাবে অব্যাহতি দাবি করতে পারে না। কিন্তু সমালোচনাটি শোভন ভাষায় নিরপেক্ষ, অনুভূতিপূর্ণ, সঠিক ও যথাযথ হতে হবে। সম্পূর্ণভাবে যেখানে সমালোচনার ভিত্তি হচ্ছে সত্যবিকৃতি ও পুরো বানোয়াট এবং বিচারকের ন্যায়পরায়ণতার ওপর কটাক্ষপূর্ণ ও বিচার বিভাগের সম্মান খাটো করা ও জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দেয়া এটা উপেক্ষা করা যায় না। যেহেতু আইনের মহার্ঘতা অবমাননাকারীদের দ্বারা কালিমা লিপ্ত করার অনুমতি দেয়া যায় না।
রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে আদালতের রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা করার। রায়ের সমালোচনা হতে কোনো দোষ নেই কিন্তু যে বিচারক সে রায় প্রদান করেছেন তাকে তার রায়ের জন্য ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা বা কোনো প্রকারের আক্রমণ করা যাবে না। যদি কোনো রাষ্ট্রে সে রকমটা হতে থাকে তবে সে রাষ্ট্রের বিচার প্রতিষ্ঠান চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ও গণতান্ত্রিক ধারা হুমকির মুখে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনা পত্র গৃহীত হয়। সে ঘোষনার ধারা-১৯ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই মতামত পোষন করা ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া মতামত পোষন করা এবং যে কোনো সংবাদ মাধ্যমের ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত চাওয়া, গ্রহণ করা ও জানাবার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
আদালতের মর্যদা ক্ষুন্ন না করে নিস্পত্তিকৃত মামলা সম্বন্ধে সম্পাদকীয় মন্তব্য অবমাননাকর নহে। মামলা সংক্রান্ত আদলতের কার্যাবলীর কোন কিছু গোপন বা অতিরঞ্জিত না করে ভুল বর্ণনা না দিয়ে যদি সঠিকভাবে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা যায়। তবে ঐ প্রকাশনা আদালত অবমানান কর হবেনা। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সৎ সমালোচনা করা আদালত অবমাননার আওতায় পড়বেনা। রায়ের সৎ ও আইন সম্মত মন্তব্য আদালত অবমাননা নহে। জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরপক্ষে ও যুক্তি সংঘত সমালোচনা আদালত অবমাননা নহে। যখন বিচারকের বিরুদ্ধে অসংঘত উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা করা হয় তখন প্রকৃত সমালোচনার গন্ডি অতিক্রম করা হয়।
আমরা এর আগেও দেখেছি যে,আদালত সংক্রান্ত রিপোর্ট বা বিচার সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আদালত অবমাননার মত মামলার সুত্রপাত ঘটেছে। আমাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, কি কি কারণে আদালত অবমাননা হয় বা হতে পারে। উত্তারিধার সুত্রে আমরাই বৃটিশদের প্রথা অনুসরণ করে আসছি এবং বৃটিশদের প্রথা অনুযায়ী আদালতের মর্যদা ও পবিত্রতা আরও সংরক্ষিত। তাই আদালত হলো পুরো বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দু। “রাজা কোন ভুল করতে পারেনা” এই অনুশাসন বাক্যটির মধ্যেই বিচার ব্যবস্থার এই ধারণা নিহিত রয়েছে। নির্বাহী বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ এই রাজাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কাজেই মূুল উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু বিচারই করোনা বরং পুরো বিশ্বকে দেখাও এখানে বিচার পাওয়া যাচ্ছে।
এ কারনইে আমরা মাঝে মধ্যে দেখি যে,কোন নির্দিষ্ট আদালতে হয়ত সুবিচার পাবেনা মনে করে কখনও কখনও কোন পক্ষ মামলাটি অন্য আদালতে প্রেরণের আবেদন জানায়। এমনকি সে পক্ষ আদালতের বিচারকের সামনে হাজির হয়ে বলতে পারে যে আমি কারণগুলোর জন্য আপনার কাছ থেকে বিচার পাবোনা । তবে যেকোনভাবেই হোক অবমাননার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে হলে আদালতের প্রতি সম্মান ও মর্যদা বজায় রাখতে হবে। আদালত অবমাননার দায়ে কারদন্ড বা জরিমানা উভয় দন্ড হতে পারে।
১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইনে আদালত অবমাননার স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় ২০১৩ সালে নতুন আদালত অবমাননা আইন তৈরী করে সংসদে পাশ করা হয় যা একটি মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বাতিল করে দিয়েছেন। তারপরও আদালত অবমাননাকর কিছু করা এখনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে সংবাদে জনসমক্ষে আদালতের মান মর্যাদা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে সে ধরনের সংবাদ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার করা উচিৎ নয় বা করা যাবে না। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত প্রকাশিত রায়গুলোর সারসংক্ষেপ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের একটি রায়ে, যা ১৯৮৩ সালের অল ইন্ডিয়া রিপোর্টসের ১১৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই রায়ে দেওয়া আদালত অবমাননার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘বিচার কাজে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আর নিজের পদবি একজন বিচারককে এমন প্রশিক্ষণ দেয়, যার দ্বারা তিনি সংবেদনশীল হওয়ার বদলে সহানুভূতিশীল হন। অন্যদের চেয়ে একজন বিচারক মামলারত ব্যক্তিদের অহমিকা, হতাশা, অনুভূতি ও মানসিক চাপ বেশি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম। তবুও এর একটা সীমারেখা থাকা অত্যন্ত জরুরি। একজন বিচারকের প্রতি এমন অপবাদ রচনা কখনো হতে পারে না। যার ফলে বিচারব্যবস্থা হুমকি কিংবা নষ্টের সম্মুখীন হবে। এর অর্থ এই নয় যে বিচারকদের রক্ষা করা আবশ্যক। কারণ বিচারকরা নিজেদের রক্ষা করতে অসমর্থ নন। এর প্রকৃত অর্থ জনগণের স্বার্থ ও অধিকারের উদ্দেশ্যেই বিচারব্যবস্থাকে শুধু অপবাদ-রটনা থেকে সুরক্ষা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার ব্যাপারে আরো সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সেটা হচ্ছে, ‘যদি মিথ্যা কিংবা অযথার্থ সংবাদটি প্রকাশের প্রতিক্রিয়া ওই আদালতের প্রতি সর্বসাধারণের তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞার উদ্রেক হয়, যাতে আদালতের সুশৃঙ্খল কার্যে তাৎক্ষণিক হুমকি কিংবা বিপর্যয় হয়, সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননা হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র একটি মিথ্যা বা অযথার্থ প্রতিবেদনকে তখনই অবমাননাকর বিবেচনা করা হবে, যখন প্রতিবেদনটি প্রকাশের ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আদালতের সুশৃঙ্খল কার্যে তাৎক্ষণিক হুমকি বা বিপর্যয় হবে।
১৯০৪ সালের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে ‘পোনিকেম্প’ নামে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, একজন বিচারক একটি ধর্ষণ মামলা ডিসমিস করেছেন, যেহেতু আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যথাযথ গঠন করা হয়নি এবং ফ্লোরিডার আদালত কর্তৃক অপরাধী লোকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টেকনিক্যাল বা খুঁটিনাটি কারণে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্পাদকীয়তে এ কথা লেখা উচিত ছিল যে পরদিন ওই আসামিদের বিরুদ্ধে সঠিক অভিযোগ গঠন করা হয় এবং তাদের বিচারের জন্য গঠিত জুরিদের বিদায় দেওয়া হয়নি। সম্পাদকীয়তে অযথার্থ প্রতিবেদনটি লেখার জন্য আদালত অবমাননার দায়ে ওই পত্রিকার সম্পাদকের শাস্তি হয় এই সিদ্ধান্তে যে সম্পাদকীয়তে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে পূর্ণ সত্য গোপন করা হয়েছিল।
পত্রিকাটির সম্পাদক ওই রায়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্ট আপিলটি মঞ্জুর করেন। রায়ে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে অঙ্গরাজ্যটির আদালত কর্তৃক তর্কিত সম্পাদকীয় বিষয়ে মূল্যায়ন সঠিক ছিল না। পত্রিকাটির সম্পাদককে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না। এই কারণে যে সম্পাদকীয়টির ভুল তথ্য দেওয়া ও মন্তব্য করা তেমন স্পষ্ট ও আশু আশঙ্কামূলক ছিল না, যার ফলে অঙ্গরাজ্যের আদালতগুলোর এবং বিচারকদের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতা বিকল বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিচারাধীন বিষয়ে ধ্র“পদী আলোচনা কি আদালত অবমাননাকর? প্রশ্নটির উত্তর মাদ্রাজ হাইকোর্ট দিয়েছেন ১৯৭৪ সালের হনুমন্থ রাও বনাম পণ্ডাভিরম মামলায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এখন প্রশ্নটির বিবেচনায় প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিষয়টি মনে রাখতে হবে। তা ছাড়া অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একটি ন্যায্যবিচারে মামলারত ব্যক্তিদের স্বার্থ ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ থাকতে পারে। সেটা হচ্ছে, ব্যক্তিস্বার্থের ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে জনস্বার্থের উপস্থিতি এবং সেখানে জনস্বার্থ মুখ্য বিধায় আদালতের রায়ের আগে ও পরে ন্যায্য আলোচনা ও মন্তব্য অনুমোদনযোগ্য।’
বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায়, অবাধ স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। সুস্থ দায়বদ্ধতা থেকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, এমনকি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও পূর্ণতা পায়।
লন্ডনে টেমস নদীর পাড়ে বার্নার্ড শ এক দিন মর্নিং ওয়ার্কে বেরিয়েছেন। উল্টো দিক থেকে এইচ পি ওয়েলসও আসছিলেন। তাঁর হাতে একটা ছড়ি। সেটা তিনি ঘোরাচ্ছিলেন। বার্নার্ড শর কাছে এসেও তিনি ছড়িটি ঘোরানো বন্ধ করলেন না। বার্নার্ড শ বললেন, ‘ছড়ি ঘোরানো থামাও। ওটা তো আমার নাকে আঘাত করতে যাচ্ছে।’ ওয়েলস বললেন, ‘আমি এ দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক। যেখানে খুশি সেখানে ছড়ি ঘোরানোর নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার আমার আছে।’ বার্নার্ড শ বললেন, ‘অবশ্যই সে অধিকার তোমার আছে। কিন্তু আমার নাকের ডগা যেখানে শেষ, সেখান থেকে তোমার নাগরিক অধিকারের শুরু।’
বার্নার্ড শর এই মন্তব্য থেকেও বোঝা যায়, একজন নাগরিকের স্বাধীনতারও একটা সীমা ও দায়বদ্ধতা আছে। সেটা অন্য নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে যখন বাকস্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তখন কয়েকজন সম্পাদক বার্ট্রান্ড রাসেলকে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাসেল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব আমার কাছে এখন বেশি বিবেচ্য। নাগরিক স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এই মুহূর্তে আমার কাছে বেশি বিবেচ্য নয়।’
লেখকঃ বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, ‘সংবাদপত্র বিষয়ক আইন’ গ্রন্থের প্রণেতা ও গবেষক। ই-মেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স, মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮, তাং-১.৫.২০১৫
Discussion about this post