ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম পবিত্র হজ্ব, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাবলীগ জামাতের বিরুদ্ধে চরম সীমালংঘনকারী বক্তব্য ও বেয়াদবীর দায়ে অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তি দাবী করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তিনি হেফাজতের ইসলামের নেতা-কর্মী, উলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতার প্রতি মুরতাদ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকির গ্রেফতার ও বিচারের দাবীতে শুক্রবার বাদ জুমা দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ-মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামের ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্নে হেফাজতে ইসলাম কখনোই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেলে সংবাদপত্রে দেওয়া বিবৃতিতে হেফাজত আমীর উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
হেফাজত আমীরের প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে হেফাজত আমীর আরো বলেন, পবিত্র মাহে রমযানের সিয়াম সাধনার সময় আব্দুল লতিফ সিদ্দিকিকে মুক্তি দেওয়া তৌহিদী জনতার ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসের সাথে তামাশা করার শামিল। দেশের প্রতিটি নবীপ্রেমিক মুসলমান এতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। তিনি বলেন, যে লোকটার অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মন্ত্রীসভা থেকে বহিষ্কার করা হলো, ক্ষমতাসীন দলের প্রাথমিক সদস্যপদ পর্যন্ত বাতিল করা হলো, যার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অসংখ্য মামলা হলো, ব্যাপক দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ আসল, এতবড় একজন অপরাধী জামাই-আদরে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়িয়ে মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাবে, তা হতে পারে না। তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হলে সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকে কী করে? অথচ পত্রিকায় স্পীকারের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর আসছে, তার সংসদে যোগ দিতে বাধা নেই। তিনি বলেন, এতে বুঝা যায় আব্দুল লতিফ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে এতদিন যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, জনগণকে বোকা বানাতেই এসব প্রচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এদেশের উলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যেমন গভীর যতœবান, তেমনি তারা আইনকে কখনোই নিজের হাতে তুলে নিতে যায় না। তাই হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে উলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছে যে, ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে কঠোর আইন পাশ করে তার আওতায় অপরাধীদের বিচার করা হোক।
হেফাজত আমীর আরো বলেন, মুরতাদ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও ইসলাম অবমাননাকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ। সর্বস্তরের মুসলমানরাই এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কারণ, মহানবী রাসূল (সা.) ও হজ্বের বিরুদ্ধে জঘন্য বক্তব্য দেয়ার পর এই আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী কোন অবস্থাতেই আর মুসলমান নেই। নিঃসন্দেহে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে বেঈমান ও মুরতাদ হয়ে গেছে। হজ্ব ইসলামের মূল ভিত্তি বা রোকনের অন্যতম একটি রোকন। ইসলামের রোকন অস্বীকারকারী কখনোই মুসলমান বলে বিবেচিত হয় না। আল্লাহতায়ালা সূরায়ে আল-ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা বায়তুল্লাহ পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর হজ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি জগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন’। এ বিধানকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করে লতিফ সিদ্দিকী আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে চরম বেয়াদবি করেছেন।
তিনি বলেন, ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ পবিত্র হজ্ব একটি ফরয ইবাদত। এই সম্পর্কে কটূক্তি করার এখতিয়ার কারো নেই। কোন মুসলমান পবিত্র হজ্বের বিরোধিতা করতে পারে না। কোন মুসলমান হজ্বের বিরোধিতা করলে তার ঈমান থাকে না। তাছাড়া মহানবী (সা.) পৃথিবীর দেড়শ’ কোটি মুসলমানের কাছে নিজের জীবনের চাইতেও প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি মানবতার মুক্তির দূত এবং মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। কোন মুসলমান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে পারে না। তার নাম শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে দরূদ পাঠ করা সকল মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
হেফাজত আমীর বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে এক শ্রেণীর লোকজন যে হারে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও অবমাননাকে একটা ফ্যাশনে পরিণত করেছে, বিশ্বের কোথাও সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা দেখা যায় না। ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্তার পক্ষে কেউ কথা বললেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্ণিত করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। মুক্তমনা ও সাংস্কৃতি চর্চার নামে কার্যতঃ ইসলাম ও মুসলমানদেরকে টার্গেটে পরিণত করে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে অহরহ। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এমনটা কখনোই চলতে পারে না, চলতে দেয়া যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, এদেশকে স্বাধীন করা হয়েছে জুলুম-অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে, ইসলাম ও মুসলমানদের উপর আঘাত হানার জন্য নয়। ইসলাম ও মুসলিম চেতনার বিপক্ষে যারা কথা বলে, তারা দেশ ও জাতির দুশমন। তিনি বলেন, দৃশ্যতঃ সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি বাদ দেওয়া এবং ধর্মহীন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের পর থেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে মুছে ফেলে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র জোরদার করা হয়েছে।
হেফাজত আমীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে দেশে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর অবমাননার জন্য ৭-১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা আর্থিক জরিমানার আইন করে তা কার্যকরও করা হচ্ছে, অথচ কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন মহানবী ও ইসলামের অবমাননাকারীর দৃশ্যতঃ কোনই শাস্তি হয় না।
এদিকে হেফাজত আমীরের প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ জানান, গত দু’দিনে পর পর দুই দফা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ হেফাজত আমীরের সাথে বৈঠক করেছেন। বুধবার বিকেল ৩টায় হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সাথে সাক্ষাত করেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাে র এডিশনাল এসপি নাঈমুল হাসান, এএসপি রবীউল ইসলাম এবং হাটহাজারী থানার অফিসার্স ইনচার্জ মোহাম্মদ ইসমাঈল। তাঁরা কুশল বিনিময় শেষে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে মাঠ পর্যায়ে কোন কর্মসূচী না দিতে হেফাজত আমীরকে অনুরোধ জানালে তিনি অবিলম্বে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখী করার দাবী জানান।
এর পরদিন গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তারের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাে র এএসপি রবীউল ইসলাম এবং হাটহাজারী থানার অফিসার্স ইনচার্জ মোহাম্মদ ইসমাঈল হেফাজত আমীরের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাগণ শুক্রবারের বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী স্থগিত করতে হেফাজত আমীরকে অনুরোধ করেন। এসময় পুলিশের আইজি শহীদুল হক টেলিফোনে হেফাজত আমীরকে একই অনুরোধ করেন। হেফাজত আমীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দের প্রতি অবিলম্বে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকে গ্রেফতারের দাবী জানিয়ে বলেন, একজন অপরাধীকে কোন বিচার ছাড়া আপনারা কীভাবে ছেড়ে দিলেন? আত্মস্বীকৃত মুরতাদ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা ছাড়া উলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতা শান্ত হবে না। আমরা কোন রাজনৈতিক দাবী করছি না। এটা ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামের ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্ন। এ বিষয়ে বর্তমানে পুরো জাতি একতাবদ্ধ। একজন অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে পুরো জাতিকে মানসিক আঘাত দিয়ে বিক্ষুব্ধ করে তোলার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। স্বাঘোষিত এই মুরতাদকে গ্রেফতার করুন, পরিস্থিতি আপনা আপনিই শান্ত হয়ে যাবে। এ পর্যায়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশংকা প্রকাশ করলে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, হেফাজতে ইসলাম সব সময় আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তির প্রতি আনুগত্যশীল। আমাদের সকল কর্মসূচী শন্তিপূর্ণভাবেই পালিত হয়ে আসছে। এ পর্যায়ে হেফাজত আমীর শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচী বাস্তবায়নে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।
Discussion about this post