ক) “বাল্য বিবাহ” বলতে ওই বিবাহকে বুঝাবে যাতে পক্ষদ্বয়ের যে কোন একজন “শিশু” বা নাবালক হবে।
খ) “শিশু” বা নাবালক বলতে ওই ব্যক্তিকে বুঝাবে যার বয়স পুরুষ হলে “একুশ” বৎসরের নিচে এবং স্ত্রী হলে “ আঠারো” বৎসরের নিচে হবে;
গ) “বিবাহের পক্ষ” বলতে যে দুই জনের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, অথবা হতে চলেছে এমন যে কোন একজনকে বুঝাবে;
বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। বিশেষ করে তখন, যখন সেটি বাল্যবিবাহের পর্যায়ে পড়ে। এটি আইনত নিষিদ্ধ হলেও হরহামেশাই হচ্ছে। যার পরিণতিতে কিশোরী মায়েরা পড়ছে নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। যা রোধ করতে প্রয়োজন সামাজিক চেতনা, প্রয়োজন এক কণ্ঠে-এক সুরে বাল্যবিবাহকে না বলা।
চৌদ্দ বছরের কিশোরী ফাতেমা তার নতুন সংসারের দাওয়ায় বসে স্বপ্ন দেখছে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানো একটি ছোট শিশুর। যে শিশু দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপ দিয়ে বলবে, মা আমাকে কোলে নাও। আর ক’দিন পরই কোলজুড়ে ফুটফুটে একটি শিশু ফাতেমার বুক ভরিয়ে দেবে; ভুলিয়ে দেবে সব যন্ত্রণা। অনাগত সে সন্তানের মুখ চেয়ে সব ব্যথা ভুলে যাবে এটাই তার প্রত্যাশা ছিল।
১৪ বছরে পা দেয়ার আগেই কিশোরী ফাতেমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই ফাতেমা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। মাতৃত্বের দায়িত্ব-কর্তব্য বুঝে ওঠার আগেই সে সন্তান ধারণ করে। নিরাপদ প্রসবের জন্য কী কী করতে হয়, কিভাবে সন্তান লালন-পালন করতে হয় এসব কিছুই তার জানা ছিল না। তা সত্ত্বেও ফাতেমা অনাগত সন্তানের আগমন বার্তার আশায় বুক বেঁধেছিল। মা হতে কে না চায়? কিন্তু মায়ের কর্তব্য বুঝার আগেই সন্তান ধারণ করে সে নিজের বিপদ ডেকে আনে। অশিক্ষিত এবং দরিদ্র শ্রেণীর লোকের মধ্যে বাল্যবিবাহ এবং অকাল মাতৃত্বের প্রবণতা বেশি। বিত্তবান এবং শিক্ষিত লোকের মধ্যে এ হার অনেকটা কম। একইভাবে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহ এবং অকাল মাতৃত্বের হার বেশি।
বিশ্বের যে ক’টি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রচলন খুব বেশি। কারণ গ্রামের দরিদ্র মানুষরা তাদের দারিদ্র্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ কাজের লোকের অভাব পূরণের জন্য অল্প বয়সের ছেলেকে বিয়ে করান। এ রকম আরও অনেক কারণে গ্রামে বাল্যবিবাহের বিস্তার ঘটে। সরকার অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা, উপবৃত্তি ইত্যাদি ব্যবস্থা করার পরও এর হার কমছে না। উপরন্তু ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ, তারপরও এ বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না।
দেশে বর্তমানে সংগঠিত বিয়ের ওপর চালানো এক হিসাবে জানা গেছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে বেশি। অথচ ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দেয়া আইনত অপরাধ। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়ার হার বেশি? এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, চরম দারিদ্র্যতা, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌতুকের পরিমাণ বাড়া ইত্যাদি বিষয়গুলোর কারণে উল্লিখিত বয়সের মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয়। রিপোর্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় এবং গত দুই দশক এর হার প্রায় একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ডেম্রোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭ অনুযায়ী এ হার প্রায় ৭০-এর কাছাকাছি। সঙ্গে সঙ্গে তারা এ তথ্যটিও প্রদান করেছে, এক্ষেত্রে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স সাড়ে ১৫ বছর। মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা এবং গ্রামের মেয়েদের কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে কিশোরীদের মধ্যে বাল্যবিবাহ-বিরোধী আওয়াজ জোরদারের কথা বলছে নারী ও শিশু বিষয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠিত জরিপের তথ্যমতে, এদেশে ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৭৪ শতাংশেরই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন দারিদ্র্য, মেয়েদের নিরাপত্তা, পরিবারের সম্মান রাখার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এসবই বাল্যবিবাহের মূল কারণ। বাল্যবিবাহ আমাদের এক সামাজিক সমস্যা, বলা যায় সামাজিক ব্যাধি। সার্বজনীন পারিবারিক আইন না থাকার কারণে এ ব্যাধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও বিস্তার লাভ করছে। জন্ম নিবন্ধন চালু হলেও তা না করানোর কারণে মেয়েদের প্রকৃত বয়স প্রমাণ করা যায় না। ফলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক যে কাউকে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে চালিয়ে বিয়ে দেয়া হয়। টাকার বিনিময়েই সাধারণত এ ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। তাই এ অবৈধ পদ্ধতি শক্ত হাতে প্রতিহত না করলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো দুরূহ।
ইউএনএফপি’র গবেষণা মতে, উন্নয়নশীল দেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৮ কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয় প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে। আর এরাই মানসিক, শারীরিক ও যৌন জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাল্যবিবাহের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে এবং এর ফলে সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ কমছে। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কায়িক পরিশ্রমের কারণে প্রায় ৫৫ শতাংশ কন্যাশিশু মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে। তাদের গবেষণায় আরও দেখা যায়, কন্যাশিশুকে সামাজিক নিরাপত্তা না দিতে পারা, বিয়ের প্রস্তাব বা কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয়েও বাল্যবিবাহ দেয়া হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও বাড়ছে যখন দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে বরের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে কনের বয়স ১৩ বছরের মধ্যে। ইউনিটারিয়ান সার্ভিস কমিটি কানাডার গবেষণায় উপরিউক্ত তথ্য প্রকাশিত হয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালকের মতে, মেয়ে পক্ষ মনে করে, কম বয়সে বিয়ে না দিলে পরে অনেক বেশি যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তারা এটা ভাবে না যে, কম বয়সে বিয়ে দিলেও পরে যৌতুকের চাহিদা থাকে এবং সময়ে সময়ে তা বাড়তেও পারে।
বাল্যবিবাহের মতো এরূপ সামাজিক সমস্যার সামগ্রিক পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। বাল্যবিবাহের কারণে তাদের সন্তানদের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার বিষয়গুলো অভিভাবকদের বেশি করে জানাতে হবে। তাছাড়া যৌতুক বন্ধের নিশ্চয়তা দেয়া গেলে কোন অভিভাবকই তাদের সন্তানদের এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দিতে চাইবেন না। ইউনিসেফের সহযোগিতায় কিশোরীদের সচেতন করার জন্য ২৮টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিশোরীরাই। তবে সম্মিলিত প্রতিরোধ আর জন্ম নিবন্ধনের ব্যাপারটি যদি একসঙ্গে নিশ্চিত করা যায় তাহলে বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশ সফল হবে বলে তাদের ধারণা।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জাতি গঠনের স্বার্থে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সামাজিকভাবে গণজাগরণ সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। এ গণজাগরণ সৃষ্টির অন্যতম হলো সুশিক্ষা, সচেতনতা ও কার্যকর প্রচারণা। বিশেষ করে মেয়েদের চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। ইতোমধ্যেই সরকার কর্তৃক মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বাল্যবিবাহ রোধের জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তাই আমরা বাল্যবিবাহ রোধ করে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
বাল্য বিবাহের শাস্তি
এক মাস মেয়াদ পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড কিংবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকারের দন্ডই হতে পারে। এ শাস্তি বাল্য বিবাহকারীর, বিবাহ সম্পন্নকারীর এবং অভিভাবকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ বিবাহ আয়োজনকারী, যারা বিবাহ আয়োজনে জড়িত থাকবে তাদের ক্ষেত্রেও এই শাস্তি প্রযোজ্য। এ আইনে সংঘটিত কোন অপরাধ সম্পূর্ণরূপেই ফৌজদারী অপরাধ। সুতরাং নিঃসন্দেহে এর বিচার পদ্ধতি ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের আওতাভুক্ত। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬০(এফ) (ক) ধারার অধীন অনূর্ধ্ব ছয় মাস মেয়াদের কারাদন্ডযোগ্য অপরাধগুলির বিষয় সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের কোন অপরাধ সংঘটিত হলে এর বিচার ফৌজদারী বিধি আইনের ২৬০(ক) ধারার আওতাভুক্ত হবে।
বাল্য বিবাহ নিরোধ কল্পে নিকাহ রেজিষ্ট্রার/ কাজী সাহেবের দায়-দায়িত্ব
১. নিকাহ রেজিষ্ট্রার/কাজী বা পুরোহিত বিবাহ সম্পন্ন করার পূর্বে ছেলে ও মেয়ের বয়স সম্পর্কে যুক্তিসংগত অনুসন্ধান করবে এবং এই মর্মে পরিতুষ্ট হবে যে, বর বা কনের কেউ শিশু বা নাবালক নয়। (অওজ ১৯৩৭ (গধফ)৪৯০)
২. বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কাজী সাহেব বিয়ে রেজিষ্ট্রি করবে না। এ ব্যাাপারে কাজী সাহেব, ইমাম সাহেবদের বিয়ে পড়ানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিবে।
৩. কাজী সাহেব বয়স নিশ্চিত হবার জন্য বর ও কনে উভয়েরই বয়সের সার্টিফিকেট চেতে পারে। অর্থাৎ বয়স নিশ্চিত হবার জন্য কাজী সাহেব যে কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে। প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রেশন আইনানুযায়ী কাজী সাহেবকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
৪. কাজী সহেব বাল্য বিবাহের আইনগতদিক তুলে ধরে জনগণের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করবে।
বাল্য বিবাহের ফলে ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে কি কি খারাপ প্রভাব পড়ে সে ব্যাপারে কাজী এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবসহ সমাজের সবাই সচেতন ব্যক্তিগণ সচেতনতা সৃষ্টি করবে।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক,সাংবাদিক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com
Discussion about this post