আইন-আদালতের নজর এড়িয়ে প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে জেল খাটেন অন্যজন। এমন গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে এই দেশে। ‘আয়নাবাজি’ নামের সেই সিনেমার মতো বাস্তবেও এমন ঘটনার দেখা মিললো এবার।
হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রিট আবেদনের শুনানিতে এমন একটি ঘটনা ধরা পড়ে। বুধবার (১৯ জুলাই) শুনানি শেষে বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ও এসএম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত দু’জনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মামলা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, মালেয়েশিয়ায় নেয়া হবে এবং সঙ্গে দেয়া হবে দুই লাখ টাকা। এজন্য একটি কাজ করতে হবে। তা হলো ধর্ষণ মামলায় আসামি সেজে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এমনই এক চুক্তিতে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন আরিফ খান। তিনি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চক পালপাড়া গ্রামের আরজ খানের ছেলে। কিন্তু বিদেশ আর যাওয়া হয়নি তার। ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে যেতে হয় কারাগারে।
হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে উদঘাটিত হলো এই জালিয়াতির ঘটনা। অবশেষে আরিফ খান ও আয়নাল হককে কারাগারে পাঠিয়েছেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ও এসএম মজিবুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্জ ওই দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
আদালতে আসামি আয়নাল হকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া, আজমিনা বেগম ও কামরুন্নাহার সীমা। আরেক আসামি আরিফ খানের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ মিয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুন-অর-রশিদ।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের জানান, এ আদেশের সময় আদালত বলেছেন যে, ‘এ ঘটনা জঘন্যতম। এটা বিচার বিভাগের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধ করতে না পারলে বিচারবিভাগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সঠিক ধারণা পাবে না। টাকা-পয়সা দিয়ে এভাবে যারা কেনাবেচা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’
জানা যায়, আয়নাল হকের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২৮ জুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সিংগাইর থানায় ধর্ষণ মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগে ঘটনার তারিখ বলা হয় ২০০৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। এ মামলায় তদন্ত শেষে সিংগাইর থানা পুলিশ আয়নাল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর বিচার শেষে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আসামি আয়নাল হকের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়। এসময় আয়নাল হক মালয়েশিয়ায় ছিলেন। আদালত তাকে পলাতক দেখিয়ে সাজা দেয়।
এ রায়ের পর আয়নাল হক সেজে একই গ্রামের আরিফ খান ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে ২০১৪ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে কোয়াশমেন্ট (বাতিল) আবেদন করেন আরিফ খান। এ আবেদনে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। হাইকোর্টের জারি করা এই রুল বিচারাধীন রয়েছে।
এরও কিছুদিন পর আরিফ খানের মা আলেয়া বেগম তার ছেলের মুক্তির জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। তার ছেলেকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে দাবি করে এই আবেদন করা হয়। এ আবেদনে হাইকোর্ট বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশ প্রশাসনকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতে পুলিশের প্রতিবেদন না আসায় ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল হাইকোর্ট তার ছয়মাসের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। পাশাপাশি রুল জারি করেন। এরপর আরিফ খান কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই রুলটিও বিচারাধীন আছে।
আরিফ খানের মুক্তির পর আয়নাল হক ২০১৫ সালের ৫ জুন মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরেন। পরে ওই বছরের ৯ জুলাই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সেই থেকে তিনি কারাগারে। এরপর তিনি সাজা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে কোয়াশমেন্ট আবেদন করেন। পরে আদালত রুল জারি করেন। এ রুল বিচারাধীন।
এরপর হাইকোর্ট দুই আসামি আয়নাল হক ও আরিফ খান এবং আরিফ খানের মা আলেয়া বেগমকে তলব করেন। এ নির্দেশে আয়নাল হককে চলতি মাসের ৩ জুলাই কারাগার থেকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। আদালত তার বক্তব্য শোনেন। এরপর ১২ জুলাই আলেয়া বেগম হাইকোর্টে হাজির হয়ে বক্তব্য দেন। এ অবস্থায় বুধবার আরিফ খানকেও হাজির করা হয়।
আরিফ খান আদালতকে জানান, তাকে নগদ দুই লাখ টাকা প্রদান এবং বিনা টাকায় মালয়েশিয়ায় নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আয়নাল হক সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয়।
বুধবার আদালত সকল পক্ষের বক্তব্য শোনেন ও আদেশ দেন। আদেশে আরিফ খান ও তার মা আলেয়া বেগমের আবেদনে জারি করা রুল খারিজ করেন। আর আয়নাল হকের আবেদনে জারি করা রুলের ওপর আগামী ২৬ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন।
Discussion about this post