ঠান্ডা-গরমে লড়াই চলছিলই। জাতীয় আইন দিবসে দিনভর চলল দফায় দফায় তোপ ও পাল্টা তোপ। যেখানে কার্যত নজিরবিহীন ভাবে পরস্পরকে লক্ষ্মণরেখা না পেরোনোর হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়ে রাখল দু’পক্ষ। যে মৌখিক সংঘর্ষের এক দিকে দেশের প্রধান বিচারপতি, অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে কখনও আইনমন্ত্রী, কখনও অ্যাটর্নি জেনারেল।
প্রথমে বিভিন্ন হাইকোর্টে ৫০০ বিচারপতির পদ ফাঁকা থাকা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে কেন্দ্রকে সক্রিয় হতে বললেন প্রধান বিচারপতি তীর্থ সিংহ ঠাকুর। তাঁর সেই বক্তব্য খারিজ করলেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। পরে অন্য এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বললেন, সরকারের কোনও শাখা যেন লক্ষ্মণরেখা পার না করে। অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি তখন সেখানে উপস্থিত। তিনি আবার আর এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির সামনেই বললেন, বিচার বিভাগ যেন ওই লক্ষ্মণরেখাটার কথা মাথায় রাখে।
মূলত বিচারপতি নিয়োগ নিয়েই সাম্প্রতিক অতীতে চরমে উঠেছে সরকার ও বিচার বিভাগের সংঘাত। কখনও বিরোধ হয়েছে বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে, কখনও বিভিন্ন হাইকোর্টে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ৪৩ জন বিচারপতির নাম ফেরত পাঠিয়েছে কেন্দ্র। প্রধান বিচারপতি ঠাকুর নিয়মিতই বলেন, বিচারপতির অভাবে কী ভাবে জমে যাচ্ছে মামলার পাহাড়। আজ সকালে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল (ক্যাট)-এর সর্বভারতীয় সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে সারা দেশে অনেকগুলি আদালত কক্ষ ফাঁকা পড়ে রয়েছে, অথচ বিচারপতি নেই। আমি আশা করব এই সঙ্কট কাটাতে সরকার হস্তক্ষেপ করবে।’’
ট্রাইব্যুনালগুলির দুর্দশা নিয়েও অসন্তোষ জানান প্রধান বিচারপতি। বলেন, লোকবলের অভাব ছাড়াও পরিকাঠামোর সমস্যা রয়েছে ট্রাইব্যুনালগুলিতে। ফলে পাঁচ থেকে সাত বছরের পুরনো মামলা জমে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতির কথায়, ‘‘সরকার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধে দিচ্ছে না। নিয়োগের সমস্যা তো রয়েইছে। এমন একটা অবস্থা এসেছে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিই ট্রাইব্যুনালগুলির নেতৃত্ব দিতে চান না।’’
এর পাল্টা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, ‘‘আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে জানাই, একমত হতে পারছি না। এ বছর আমরা (হাইকোর্টে) ১২০ জনকে নিয়োগ করেছি। সর্বোচ্চ নিয়োগ ছিল ২০১৩-য়— ১২১ জন। তার আগে ১৯৯০ থেকে মাত্র ৮০টি নিয়োগ হয়েছিল। আর নিম্ন আদালতে যে পাঁচ হাজার পদ খালি রয়েছে, সেখানে তো কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই।’’
এই যদি লড়াইয়ের প্রথমার্ধ হয়, তা হলে দ্বিতীয়ার্ধ ছিল সুপ্রিম কোর্টের লনে। যেখানে প্রধান বিচারপতি ঠাকুর ওই লক্ষ্মণরেখার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘সবাই নিজের গণ্ডির মধ্যে রয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিচার বিভাগকে।’’ পরবর্তী অনুষ্ঠানটিতে প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের পাশাপাশি হাজির ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে এস খেহর। জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি ঠাকুরের অবসরের পর সবচেয়ে বর্ষীয়ান হিসেবে বিচারপতি খেহরেরই সেই পদে আসার কথা। অ্যাটর্নি জেনারেল রোহতগি ওই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘বিচার বিভাগ-সহ সকলে যেন ওই লক্ষ্মণরেখাটা মনে রাখে এবং আত্মসমীক্ষার জন্য তৈরি থাকে।’’ তখন বিচারপতি খেহর বলেন, ‘‘সংবিধানের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সব সময়েই লক্ষ্মণরেখাটিকে মনে রেখেছে। জরুরি অবস্থা সংবিধানের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলো দেখিয়ে দিয়েছে।’’
সেই জরুরি অবস্থার জের টেনে এর পরেও তোপ জারি রেখেছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর। বলেছেন, ‘‘জরুরি অবস্থার সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ব্যর্থ হয়েছিল। সাহস দেখিয়েছিল হাইকোর্টগুলি। কোর্ট সরকারের নির্দেশ খারিজ করতে পারে। কিন্তু নির্বাচিত ব্যক্তিদেরই সরকারটা চালানো উচিত।’’ সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
Discussion about this post