সিরাজ প্রামাণিক
মানবদেহের রোগ মুক্তির দায়ভার যেমন একজন ডাক্তারের উপর অর্পিত থাকে, ইঞ্জিনিয়ার তার ইটের গাঁথুনিতে অবকাঠামোর ভিত গড়ে, ঠিক তেমনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে বিচারাঙ্গণ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। দার্শনিক রোজার ডাটেন্স বলেছিলেন, ‘বাঁচ এবং বাঁচতে দাও এই হলো সাধারণ বিচারের কথা’। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে’। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে’। আমাদের বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত উক্তিগুলি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।
একজন আইনবিদ যদি বিচার-বিবেচনা না করে তার মক্কেলকে ভুল পথে চালান, তবে তিনি নৈতিকতা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন এবং এ কারণে তিনি আইন পেশার অধিকার হারাতে পারেন। ঠিক তেমনি পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিচারকরাও যথেচ্ছা করলে নৈতিকতা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। একজন বিচারককে অবশ্যই আইনজীবী এবং বিচারপ্রার্থী জনগনের প্রতি ধৈর্য্যশীল এবং সম্মানজনক আচরন প্রদর্শন করতে হবে।
বিচার হলো মূলত আইনের আবরণে একটি বিবাদমান দলের মধ্যকার বিরোধের বিষয়ের উপর একটি সিদ্বান্ত বা রায়। একটি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে চূড়ান্ত রায়ে রূপান্তরিত করতে বিচারক, আইনজীবী, পক্ষ-বিপক্ষ, সাক্ষী একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আইনজীবী আদালতের সামনে সাক্ষ্য প্রমাণ, জেরা, জবানবন্দী এবং সংশ্লিষ্ট আইনের উপস্থাপন করে থাকেন। মূল কথা হলো আদালতকে সঠিক সিদ্বান্তে সাহায্য করাই আইনজীবীদের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব। প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় এককভাবে আদালতের পক্ষে সত্যকে উৎঘাটন করে আইনের সমর্থিত সিদ্বান্তকে ঘোষণা করা সর্বাবস্থায় সম্ভব নয় এবং এ কারণেই আদালত ও আইনজীবীদের যৌথ সহযোগিতায় বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষিত হয়। আর এই সত্যতার স্বীকৃতি ঘটেছে উচ্চ আদালতের সিদ্বান্তে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের বহু জেলাতে আইনের কূটতর্কের বিষয়টি ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে পড়ায় বহু ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের মধ্যকার উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে আদালত বর্জন অনুষ্ঠান চলে। এই অবস্থা কখনও কাম্য নয় এবং তা ন্যায়বিচার প্রত্যাশীদের গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার সামিল বলে গণ্য হবে। যা সভ্যতার বিকাশে পর্বতসম বাঁধা। কেননা আইন ও বিচারের প্রতি জনমানুষের শ্রদ্ধাহীনতা যদি বিচারকে পক্ষদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে তবে সামাজিক শৃঙ্খলা অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়বে। যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সত্যি দূরহ হবে। সেকারণ বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে যার যার অবস্থান থেকে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। যাতে পক্ষগণ অন্ততঃ বুঝতে পারেন যে, আদালতে ন্যায় বিচার হয়েছে। সর্বোপরি পক্ষগণ যাতে বিচারকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন, সেইরকম আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে পক্ষদের ভূমিকাও নেহায়াত কম নয়। বিচারকের চোখ অন্ধ, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে, আইনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে তিনি রায় ঘোষণা করেন। এখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ নেই। যদিও দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫১ ধারা, ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারা আদালতকে বিপুল ক্ষমতা প্রদান করেছে। তবে আদালতের এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আইনের বিকল্প নয় বরং আইনের অনুপস্থিতিতে বিচারকের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায় বিচারের জন্য অথবা আদালতের পরোয়ানার অবমাননা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় বিচারক আইন অনুযায়ী তাঁর বিচারকর্ম সম্পাদনে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারের রায় কোন এক পক্ষের অনুকূলে গেলে বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট হবেন হেন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরী। কেননা বিচারক শুধুমাত্র তাঁর নিকট উপস্থাপিত সাক্ষ্য, প্রমাণ, যুক্তি তর্ক বিবেচনায় রায় প্রদান করেন। এক্ষেত্রে পক্ষদের দূরদর্শিতা, সময়োপযোগী পদক্ষেপ, মামলার আলামত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতা, সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন ইত্যাদি রায় নির্ধারণে বহুলাংশে ভূমিকা রাখে। যার অভাব হেতু বিচারের বানী নিভৃতে কেঁদে যাবে বিচারকের অগোচরে। আর আইনজীবীগণ মিথ্যাবাদী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবে!
এক্ষেত্রে একটি উদাহরনের অবতারনা করা আবশ্যক। একজন ব্যক্তি কর্তৃক অপর একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি একটি খুন বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে একজন মানুষ অপর একজন মানুষ কর্তৃক মৃত হলেই তা খুন বলে বিবেচিত হবে না। তা ক্ষেত্র বিশেষে নরহত্যা হিসাবে গণ্য হবে। কারণ আইনে নরহত্যা এবং খুন দুটি ভিন্ন অপরাধ যা দন্ডবিধির ধারা যথাক্রমে ২৯৯ ও ৩০০ তে বর্ণিত আছে। ঠিক তেমনি একজন মানুষকে হত্যা করেও হত্যাকারী বেকসুর খালাস পাওয়ার দাবী রাখে যা দন্ডবিধির ৯৬ ধারায় (ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার প্রয়োগকালে কৃত কোন কিছুই অপরাধ বলে গণ্য হবে না) বর্ণিত হয়েছে। কতিপয় ক্ষেত্রে দেহ (১০০ ধারা) এবং সম্পত্তি (১০৩ ধারা) রক্ষায় আক্রমণকারীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো আইনের দৃষ্টিতে কোন অপরাধ হবে না। এক্ষেত্রে একজন আইনজীবী যদি তাঁর মক্কেল কে নির্দোষ দাবী করেন কিংবা এই যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, আমার মক্কেল খুন করেননি তবে তা আইন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে সঠিকভাবে বোধগম্য হবে না বরং তিনি আইনজীবীকে মিথ্যাবাদী হিসাবে বিষোদগার করে যাবেন। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ আইনের এই সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবহেতু তা অধরাই থেকে যাবে
অতীতে সম্ভান্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পিপাসার অন্যতম খোরাক ছিল আইন। ফলে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, মননশীলতা, উন্নত আচরণ আইন পেশাকে অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল আর জয় করেছিল মানুষের হৃদয়। কিন্তু এখন গণেশ উল্টে গেছে, দিক ভ্রান্ত পথিকের ভারে আইন পেশা দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ছে! সাধারণ মানুষের কাছে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, আইন পেশায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। তাই রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় অন্য একটি পেশা ছেড়ে দিয়ে শেষ বেলাতে আইন পেশার দ্বারস্থ হন অনেকেই। নির্দিষ্ট বয়সসীমা না থাকায় অনেক সময় নীতি নৈতিকতাহীন ব্যক্তিবর্গের আগমনেরও সুযোগ ঘটে। ফলে হয়রানির স্বীকার হয় বিচার প্রত্যাশী অসহায় মানুষগুলো। তাই বলে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের প্রতারণায় দায়ে একটি পেশাকে ঢালাও ভাবে দোষারোপ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। তবে প্রত্যেকটি পেশায় কতিপয় ব্যক্তি তাদের কৃত কর্মের সমালোচনা তথা ক্ষেত্র বিশেষে শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য বটে। এক্ষেত্রে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ গুরুদায়িত্ব পালন করে। কিন্তু বিচার বিভাগের একার পক্ষে তা অনেকাংশেই অসম্ভব।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। আলোর নিচের অন্ধকার, সত্যের আড়ালে অসত্য, সমাজের আনাচে কানাচে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের সঙ্গতি আর অসঙ্গতির চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরতে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করে। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন, উক্ত রিপোর্টটি কোন ভাবেই সামাজিক বিশৃঙ্খলতাকে প্ররোচিত না করে কিংবা আদালত অবমাননার সামিল বলে গণ্য না হয়। বিচারাঙ্গন বা কোন বিশেষ বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা মহামান্য প্রধান বিচারপতির গোচরীভূত করা জরুরী। বিচারাঙ্গন সম্পর্কে ঢালাওভাবে মন্তব্য করে মানুষের শেষ ভরসাস্থল বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করা অন্যায়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দির এই যুগে সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যম তাঁর প্রেসের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নেই বরং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।
Discussion about this post