অ্যাডভোকেট সোয়েব রহমান
খতিয়ান হলো জরিপ শেষে প্রস্তুতকৃত জমির লিখিত হিসাবের দলিল এখানে জমির পরিমাণ, মালিক ইত্যাদি তথ্য সংরক্ষিত থাকে, ২০ বছর পর পর ভূমি জরিপ (ভূমিশুমারি) করা হয়
বাংলাদেশে ভূমির খতিয়ানের প্রকার:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৪ ধরনের খতিয়ান রয়েছে। যথা –
(১) সি,এস খতিয়ান, (২) এস, এ খতিয়ান (৩) আর, এস খতিয়ান, (৪) বি, এস খতিয়ান/ সিটি জরিপ।
(১) সি, এস/ CS খতিয়ানঃ সিএস খতিয়ান-এর পূর্ণরূপ- Cadastral Survey. ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪০ সালে সরকার জরিপের মাধ্যমে যে খতিয়ান প্রস্তত করেন তাকে সি, এস খতিয়ান বলে
সি, এস/ CS খতিয়ান চেনার উপায়ঃ
১. এটা উপর থেকে নিচে লম্বালম্বি ভাবে থাকবে,
২. এপিট ওপিট উভয় পৃষ্ঠায় হবে,
৩. প্রথম পৃষ্ঠায় জমিদার এবং প্রজার নামে দুইটা ভাগ থাকবে,
৪. সবার উপরে লেখা থাকবে “ বাংলাদেশ ফরম নং ৫৪৬৩” (এটা সব ফরমে একই থাকবে),
৫. অপর পৃষ্ঠায় “উত্তর সীমানা” নামে একটা কলাম থাকবে।
(২) এস, এ/ SA খতিয়ানঃ এস, এ খতিয়ান-এর পূর্ণরূপ- State Acquisition খতিয়ান
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ২৭ হতে ৩১ ধারা অনুযায়ী ১৯৫৬-৬০ সালে যে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় তাকে এস,এ (State Acquision) খতিয়ান বলে।
এস, এ/ SA খতিয়ান চেনার উপায়ঃ
১. এই খতিয়ান সবসময় আড়াআড়ি ভাবে হয়,
২. এইটা সবসময় হাতে লিখা হয়(প্রিন্ট হবেনা),
৩. এই খতিয়ানে সাবেক খতিয়ানের (CS) এবং হাল নম্বরটা থাকবে,
৪. এইটা এক পৃষ্ঠায় হবে।
(৩) আর,এস/ RS খতিয়ানঃ আর,এস খতিয়ান এর পূর্ণরূপ হলো-Revisional Survey {RS খতিয়ান তৈরি হয় এসএ খতিয়ানের অধীনে}
এই আইনের ১৪৪ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার খতিয়ান প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেন এরূপ খতিয়ানকে বলা হয় আর,এস খতিয়ান(Renisional Survey)
আর,এস/ RS খতিয়ান চেনার উপায়ঃ
১. ফরম এর সবার উপরে হাতের ডান পাশে লেখা থাকবে “রেসার্তে নং”,
২. আগে সাধারনত ২ পৃষ্ঠায় হত, এখন এই খতিয়ান ১ পৃষ্ঠায় হয়,
৩. এটাও উপর থেকে নিচে লম্বালম্বি ভাবে হয়।
(৪) বি,এস খতিয়ান/ সিটি জরিপঃ ১৯৯৮-৯৯ সাল হতে বর্তমানে চলমান জরিপকে বি, এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ বলে। যাহা এখনো চলমান ।
বি,এস খতিয়ান/ City Survey খতিয়ান চেনার উপায়ঃ
১. এই খতিয়ানে ৯ টা কলাম থাকবে,
২. এতে আরো বলা থাকবে কি ধরনের জমি নিয়ে খতিয়ানটা(যেমনঃ নাল জমি, পুকুর)।
জমা খারিজ এবং নামজারি কি?
জমা খারিজ: যৌথ জমা বিভক্ত করে আলাদা করে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করাকে জমা খারিজ বলে। অন্য কথায় মূল খতিয়ান থেকে কিছু জমির অংশ নিয়ে নতুন জোত বা খতিয়ান সৃষ্টি করাকে জমা খারিজ বলে।
নামজারি/Mutation: ক্রয়সূত্রে/উত্তরাধিকার সূত্রে অথবা যেকোন সূত্রে জমির নতুন মালিক হলে নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারী বলা হয়।
কোন মালিক কোন জমির মালিকানা লাভ করার পর তার নাম সংশ্লিষ্ট খতিয়ানে অন্তর্ভূক্ত করা বা তার নিজ নামে নতুন খতিয়ান খোলার যে কার্যক্রম তাকে মিউটেশন (Mutation) বা নামজারী বলে । দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জরিপ ও রেকর্ড সংশোধন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বলে দুই জরিপের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার, দান, বিক্রয় ইত্যাদি হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার ফলে ভূমি মালিকানার পরিবর্তন জরিপে প্রণীত খতিয়ানে প্রতিফলিত করার জন্য অর্থাৎ খতিয়ান হালনাগাদ করার জন্য রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্র্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ১৪৩ ধারায় কালেক্টরকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। জমা খরিজ, একত্রীকরণ ও নামজারীর মাধ্যমে কালেক্টর অন্তবর্তীকালীন সময়ে খতিয়ান সংশোধন ও হালকরণ করে থাকেন । কালেক্টরের এ ক্ষমতা মাঠ পর্যায়ে বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) গণ প্রয়োগ করে থাকেন । সুতরাং অন্তবর্তীকালীন রেকর্ড পরিবর্তন, সংশোধন ও হালকরণের প্রক্রিয়া নামজারী ও জমাখারিজ নামে আখ্যায়িত।
নামজারী (Mutation) এর ধরণঃ
১। শুধু নামজারী বা নামপত্তনঃ
কোন একজন রেকডীয় মালিকের নামের পরিবর্তে ঐ একই খতিয়ানে পরবর্তী গ্রহীতাও ওয়ারিশগণের নামভূক্ত হলে তা রাস্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩ ধারা মতে শুধু নামপত্তন বা নামজারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
২। নাম পত্তন ও জমা খারিজঃ
কোন দাগের জমি বিক্রয় বা অন্য কোন প্রকার হস্তান্তরের মাধ্যমে বিভক্ত হলে এবং ঐ বিভক্তির জন্য পৃথক হিসাব বা হোল্ডিং খুলে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের আদেশ হলে তা নামপত্তন ও জমা খারিজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে জমির মালিকানার পরিবর্তন হবে এবং পৃথক খতিয়ান এবং হোল্ডিং নম্বর পড়বে। রাস্ট্রীয় অধিগ্রণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩ ও ১১৭ ধারা মতে এ প্রক্রিয়ায় নামপত্তন হয়ে থাকে।
৩। নাম পত্তন ও জমাখারিজ একত্রিকরণঃ
কোন ব্যক্তির একই মৌজার ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে জমি থাকলে উক্ত খতিয়ানগুলোতার অধিকৃত জমি একই খতিয়ানে ভুক্ত করে নামপত্তন করলে অর্থাৎ রেকর্ড সংশোধন করলে তাকে নামপত্তন ও জমা একত্রীকরণ করা বলা হয়। রাস্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩ ও ১১৬ ধারা মতে এ প্রক্রিয়ায় কাজ সম্পদিত হয়।
নামজারি/ Mutation খতিয়ান চেনার উপায়ঃ
১. এই খতিয়ানের বাম পাশে হাতে লেখা থাকবে “নামজারি”।
খতিয়ান অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহঃ
খতিয়ানে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় অর্জন বিধিমালার ১৮ নম্বর বিধিতে বিবৃত হয়েছে। এ বিধি অনুযায়ী নিম্নলিখিত বিবরণসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(ক)প্রজা বা দখলদারের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
(খ)প্রজা বা দখলদার কোন শ্রেণীল অন্তর্ভুক্ত ।
(গ)প্রজা বা দখলদর কর্তৃক জমির অবস্থান শ্রেণী, পরিমান ও সীমানা।
(ঘ)প্রজার জমির মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
(ঙ)এস্টেটের মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
(চ)খতিয়ান প্রস্তুতের সময় খাজনা এবং ২৮,২৯,৩০ বিধি মোতাবেক নির্ধারিত খাজনা।গোচরণ ভূমি, বনভূমি ও মৎস খামারের জন্য ধারণকৃত অর্থ।
(জ)যে পদ্ধতিতে খাজনা ধার্য করা হয়েছে তার বিবরণ ।
(ঝ)যদি খাজনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে যে সময়ে ও যে যে পদক্ষেপে বৃদ্ধি পায় তার বিবরণ ।
(ঞ)কৃষি কাজের উদ্দেশ্যে প্রজা কর্তৃক পানির ব্যবহার এবং পানি সরবরাহের জন্য যন্ত্রপাতি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষেণ সম্পর্কিত প্রজা ও জমির মালিকের মধ্যে অধিকার ও কর্তব্যের বিবরণ।
(ট)প্রজাস্বত্ব সম্পর্কিত বিশেষ শর্ত ও তার পরিনতি ।
(ঠ)পখ চলার অধিকার ও জমির সংলগ্ন অন্যান্য ইজমেন্টের অধিকার।
(ড)নিজস্ব জিম হলে তার বিবরণ ।
(ঢ)২৬নং ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত ও ন্যায়সঙ্গত খাজনা।
এছাড়া একটি খতিয়ানে তার নিজস্ব খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, বাট্টা নম্বর, এরিয়া নম্বর, মৌজা নম্বর ও জে, এল, নম্বর থাকে।
লেখক: আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কুমিল্লা
Discussion about this post