সিরাজ প্রামাণিক
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ভ্রুন হত্যার অভিযোগে স্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন স্বামী। গত ৩১ মে বুধবার উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামের মো. আবুল কালাম এ মামলা দায়ের করেন।
কলাপাড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মনিরুজ্জামান এর আদালত ফরিয়াদীর অভিযোগ গ্রহন করে কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসককে তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামের মো: আবুল কালাম এর সাথে পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের অধিবাসী মো: শাহজাহান মিয়ার কন্যা মোসা: আফরোজা বেগম এর সাথে প্রায় পাঁচ মাস পূর্বে রেজি: কাবিন মূলে বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী ৬ সপ্তাহের অন্ত:স্বত্তা হয়ে পড়ে। অত:পর আসামীরা অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বাদীর উপর চাপ সৃষ্টি করে বাদীর অজান্তে গ্রাম্য ডাক্তার মো: নাজমুল হাসান এর মাধ্যমে ভ্রুন হত্যার অপরাধ করে।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারা পর্যন্ত গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন ও সাজার কথা বলা হয়েছে। ৩১২ ধারায় বলা হয়েছে কোন নারী গর্ভপাত ঘটালে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি পেতে পারে।
৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্ত্রীলোকটির সন্মতি ছাড়া গর্ভপাত ঘটায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাবাস, জরিমানা বা দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
৩১৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্ত্রীলোকটির সন্মতি ছাড়া গর্ভপাত ঘটাইবার উদ্দেশ্যেজনিত কার্যে মৃত্যু ঘটায়, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাবাস বা উপযুক্ত দন্ডে দন্ডিত হবে।
৩১৫ ধারায় বলা হয়েছে, শিশু যাহাতে জীবন্ত জন্মিতে না পারে, বা উহা যাতে জন্মের পর পর মারা যায় সেই উদ্দেশ্যে কোন কার্য করিলে উক্ত ব্যক্তি দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি পেতে পারে।
৩১৬ ধারায় বলা হয়েছে, এমন কোনো কার্য দ্বারা আসন্ন প্রসব গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু ঘটানো, যাহা অপরাধজনক প্রাণনাশ বলিয়া গণ্য হয়, এমন কোনো কার্য করিলে উক্ত ব্যক্তি দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানা দন্ডে দন্ডিত হবে।
যেহেতু আমাদের দেশে গর্ভপাত ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ, সেহেতু এখানে বিষয়টি সেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না। কিন্তু মেটারনিটি ক্লিনিকগুলোয় হরহামেশাই গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে এবং গর্ভপাতের ফলে অনেক মায়েরও মৃত্যু হচ্ছে।
একটি গবেষণা সংস্থা গাটমেচারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ৪৬ হাজারের অধিক গর্ভপাত হয়, যার অধিকাংশই হচ্ছে অনিরাপদ পদ্ধতিতে। সারাদেশে প্রতি ১০০০ জন নারীর (বয়সসীমা ১৫-৪৪) ১৮.২ জন নারী গর্ভপাত ঘটান নানা কারণে এবং গর্ভপাত-সংক্রান্ত মৃত্যুর হার মোট গর্ভপাতের ১% বা প্রায় ৭ হাজার, যাদের অধিকাংশই ঘটে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে বিভিন্ন জটিলতার কারণে।
বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত অধিকাংশ আইন মূলত ব্রিটিশ আমলের ১৮৬০ সালের পেনাল কোড থেকে আসা। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালীন সময়ে গর্ভপাতের আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়। যেমন, ১৯৭২ সালের আইন অনুসারে যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছিলো। এছাড়া, ১৯৭৯ সালে মাসিক নিয়মিতকরণ বা মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের ( এমআর) অধীনে, অর্থাৎ, নারীদের ঋতুস্রাব নিয়মিত করার জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়। মূলত, বাংলাদেশে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে বৈধভাবে (আইনগতভাবে) গর্ভপাত করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রমবাদে পেনাল কোডের মূল আইন অনুসারে বাংলাদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ, শারীরিক ও মানসিক দুরাবস্থার কারণে গর্ভধারণ চালিয়ে যেতে না পারা, অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক কারণ কিংবা গর্ভের ভ্রুণের জৈব অথবা শারীরিক ক্রটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে-ও গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে গর্ভপাত আইনগতভাবে বৈধ সেইসব ক্ষেত্রে স্বামী অথবা অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ নারীর একার সিদ্ধান্তে গর্ভপাত করা যাচ্ছে না। ফলে স্বামী বা অভিভাবকবিহীন নারীদের অথবা যেসব ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি পাওয়া যায় না পারিবারিক অথবা সামাজিক অনৈক্যের কারণে সেসব ক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হন। গর্ভধারিণীর জীবন রক্ষায় গর্ভপাত বৈধ বলা হলে-ও নানা জটিলতার সম্মুখীন হন একজন নারী। যেমন, গর্ভধারিণী জীবনশংকটাপন্ন কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেই তবে বৈধভাবে গর্ভপাত ঘটানোর চেষ্টা করতে হয়। বিভিন্ন ক্লিনিকে অথবা মাতৃসদনে অবৈধভাবে (ক্ষেত্রবিশেষে বৈধ গর্ভপাতের ক্ষেত্রে-ও) যেসব গর্ভপাত ঘটানো হয় সেগুলো হয়ে থাকে দাই বা আয়া অথবা হাতুড়ে ডাক্তারদের দ্বারা। ফলে পেশাদারিত্বের অভাবে গর্ভপাত-সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। যেমন, জরায়ুতে ইনফেকশন অথবা ক্ষতের সৃষ্টি হওয়া, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া, এবং এমনকি মৃত্যুবরণ করা। ফলে নিরাপদ গর্ভপাতের প্রয়োজনেই গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন দরকার। যখন গর্ভপাত বৈধ হবে তখন অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে অথবা পেশাদার ক্লিনিকে এই সেবা নিরাপদেই পেতে পারবেন নারীরা, ফলে গোপনীয়তা ও দণ্ডের ভয়ে অনাবশ্যক ঝুঁকি নিতে হবে না। এছাড়া, নারীর গর্ভপাত একজন নারীর জন্মগত অধিকার হওয়া উচিত, নারীর শরীর নারীরই। প্রজনন দুটো মানুষের ফসল, কিন্তু নারীই গর্ভে এই ভ্রুণকে ধারণ করেন নানা কষ্ট প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, তাই গর্ভপাত কিংবা গর্ভ-সংক্রান্ত প্রথম সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত নারীরই। কোনো কারণে গর্ভধারণ হয়ে গেলেই তাকে মেনে নিতে হবে এমন হওয়া উচিত নয়, অনেক সময় অনিচ্ছা কিংবা দুর্ঘটনায় যে গর্ভধারণ হয় কিংবা যেসব ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে সেইসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গর্ভপাত-সংক্রান্ত ব্যাপারে নারীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া উচিত, এবং এই ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হচ্ছে গর্ভপাতকে আইন ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য চোখে দেখা। আমাদের দেশে নারীরা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতো মাতৃত্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার (যেমন, জোর করে বাচ্চা নিতে বাধ্য করা, গর্ভকালীন উপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা না পাওয়া ইত্যাদি); তাই নারীদের মাতৃত্ব-সংক্রান্ত কল্যাণ, বিকাশ ও স্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে গর্ভপাতের বৈধতার প্রয়োজন। এছাড়া, পৃথিবীতে এমন কোনো নজির নেই যে গর্ভপাত বৈধ করার ফলে অপরাধ কিংবা সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি বেড়ে গেছে (যেমন, অনেকে দাবি করেন যে গর্ভপাত বৈধ হলে প্রাক-বিবাহকালীন গর্ভপাতের হার বেড়ে যাবে), বরং গবেষণায় দেখা যায় যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হোক কিংবা আইনগতভাবে বৈধ হোক না কেনো গর্ভপাতের হার একই ধরণের থাকে, কিন্তু গর্ভপাত আইনগতভাবে নিষিদ্ধ থাকলে গোপন গর্ভপাতের জটিলতায় নারী বা মায়েদের মৃত্যুর হার ৩৪ গুণ বেশি হয়ে থাকে, তাই নারীর মাতৃত্ব-সংক্রান্ত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও গর্ভধারণ-সংক্রান্ত মৃত্যুর হার কমানোর জন্য গর্ভপাতের বৈধতার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন মূলত বৈষম্যমূলক এবং আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানব অধিকারের বিপক্ষে। যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন মানুষকে স্বাধীনতা বঞ্চিত করে, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক নারীর অধিকার ও সুবিধা-অসুবিধা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। কাজেই মানবিকতার দিক দিয়ে হলেও এ আইনের শীঘ্রই সংশোধনের প্রয়োজন।
Discussion about this post