বিডি ল নিউজঃ
দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে শিল্পীদের সাথে প্রতারণা করার অভিযোগে এ মাসেই মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী আসিফ আকবর। সম্প্রতি মোবাইল অপারেটরদের ওয়েলকাম টিউন নিয়ে শিল্পীদের পাওনা পরিশোধ না করা বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আসিফ আকবর। এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি অপারেটর পরিস্থিতি সমাধানে তাঁর প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তবে আসিফ বলছেন, তাদের সাথে আর আলোচনা নয়; এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজ সোমবার সন্ধায় আসিফ আকবর ফোনে জানান, এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মাবলী স্টাডি করছি। আইনজীবীর সাথে কথা বলছি এবং চলতি মার্চ মাসেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি জানান, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েলকাম টিউনের জন্য প্রতিমাসে একবার করে শিল্পীদের পেমেন্ট দিলেও বাংলাদেশি মোবাইল অপারেটররা তা শুধুমাত্র এককালীন দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। ফলে এ খাতের মানুষ মোবাইল অপারেটরদের কাছে প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
আসিফ বলেন, আমাদের একটি গানের জন্য এককালীন মাত্র সাড়ে সাত টাকা দেওয়া হয়। এটা আমাদের ৮ জনের মধ্যে ভাগ হয়। অথচ মোবাইল অপারেটররা সাড়া জীবন এর বেনিফিট গ্রহণ করে। তিনি বলেন, আমার একটি গানের জন্য প্রতি মাসে সাড়ে সাত টাকা দিলে সাত বছরের হিসেবে একটি গান থেকেই আমার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এটাকে ডাকাতি বললেও ছোট দেখা যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিল পাওনার ব্যাপারেও নানান সমস্যার কথা তিনি জানিয়েছেন। আসিফ বলেন, আমাদের বিলের সময় হলেও নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করা হয়। ফলে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে সে এ ব্যাপারে কিছু বোঝেন না বা নতুন বলে পাওনা দিতে চায় না।
‘মোবাইল অপারেটররা থার্ড পার্টির মাধ্যমে এসব সেবা দিলে তাদের দোষ কি’ এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমাদের সাথে থার্ড পার্টির চুক্তি হয় ৬ মাসের জন্য। এটা ৬ মাস পর রিভিউ করার কথা। কিন্তু তারা তা করছে না। তাদেরকে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েও কোন লাভ হয়নি বলে তিনি জানান। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশের রিয়্যালিটিশোগুলোতে সব সময় পুরাতন গান গাওয়া হয়। অথচ এ জন্য শিল্পীরা কোন টাকা পয়সা পান না। তারা অর্থের অভাবে মারা জান। এটা আর হতে দেওয়া হবে না।
আসিফ আকবরের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রামীণফোনের সাথে যোগাযোগ করা হলে গ্রামীণফোনের বহির্যোগাযোগ বিভাগের প্রধান সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, আসিফ আকবর নামের কোন শিল্পীর নাম আমি প্রথম শুনলাম। গ্রামীণফোন ওয়েলকাম টিউনের জন্য যে গান ক্রয় করে তা নির্দিষ্ট পেমেন্ট দিয়েই কিনে নিয়ে থাকে। আমরা মূলত থার্ড পার্টি থেকেই গান বা এ ধরণের সেবা নিয়ে থাকি। তবে আমরা কিন্তু গান বাজনার ব্যবসা করি না। ভয়েস আমাদের প্রধান বিজনেস। তারপরেও এ সংক্রান্ত আসিফ আকবরের কোন অভিযোগ বা ডিম্যান্ড থাকলে আমরা তা সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট দিয়ে যাচাই বাছাই করে দেখবো।
এদিকে বাংলালিংক জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান রাজিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটার জন্য বাংলালিংক কোনভাবেই রেস্পন্সেবল না। এটার সকল দায়িত্ব কনটেন্ট প্রোভাইডারদের। তিনি বলেন, চুক্তির কারণে সবাই যদি টাকা পায় তাহলে শিল্পী পাবে না কেন? প্রোডাকশন হাউজগুলো টাকা পেলেও শিল্পীদের দিচ্ছে না। এ জন্য কোন কোন শিল্পী হতাশা থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন কিছু পাওয়ার জন্য। ‘আপনাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে সে ক্ষেত্রে কি করবেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এমনটা হলে আমাদের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট বিষয়টি হ্যান্ডেলিং করবে।
কপিরাইট আইনে যা আছে
জানা গেছে, মোবাইল ফোনের রিংটোনে ও ওয়েলকামটোনে সঙ্গীতের ব্যবহার ও তার মাধ্যমে আয়ের উপকার-বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সাময়িক মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। সবাই জানতে চায়, কারা এর বৈধ মালিক বা স্বত্বাধিকারী। ধারণ উত্তর যিনি কোনো কর্মের স্রষ্টা তিনিই মালিক বা স্বত্বাধিকারী। বাংলাদেশে বর্তমানে বলবৎ কপিরাইট আইন (২০০০ ও সংশোধিত ২০০৫) অনুযায়ী ‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোন কর্মের প্রণেতা ঐ কর্মের কপিরাইটের প্রথম স্বত্বাধিকারী হইবেন’ (অধ্যায়-৪, ধারা ১৭)। আবার প্রণেতা বলতে বোঝানো হয়েছে
‘(ক) সাহিত্য বা নাট্যকর্মের ক্ষেত্রে, কর্মটির গ্রন্থকার;
(খ) সঙ্গীত বিষয়ক কর্মের ক্ষেত্রে, উহার সুরকার বা রচয়িতা;
(গ) ফটোগ্রাফ ব্যতীত অন্য কোন শিল্পসুলভ কর্মের ক্ষেত্রে, উহার নির্মাতা;
(ঘ) ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে, উহার চিত্রগাহক;
(ঙ) চলচ্চিত্র অথবা শব্দ রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে, উহার প্রযোজক;
(চ) কম্পিউটারের মাধ্যমে সৃষ্ট সাহিত্য, নাট্য, সঙ্গীত বা শিল্প সুলভ কর্মের ক্ষেত্রে কর্মটির সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।’ (ধারা ২, দফা ২৪)।
কনটেন্ট প্রভাইডার বনাম কনটেন্ট ক্রিয়েটর
বর্তমানে মোবাইল ফোনের জন্য যে সব প্রতিষ্ঠান কনটেন্ট বা বিষয় সরবরাহ করছে, তারা কনটেন্ট প্রভাইডার হিসেবে পরিচিত। আর প্রণেতা হচ্ছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা স্রষ্টা। এদের সম্পর্কে কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা বর্তমান আইনে নেই। তবে বিদ্যমান আইনের বিধান অনুযায়ী (ধারা ১৯-১) প্রণেতার (যেমন কনটেন্ট ক্রিয়েটর) কাছ থেকে বৈধ ও লিখিত চুক্তিভিত্তিক স্বত্বগ্রহণ ছাড়া কেউ (যেমন কনটেন্ট প্রভাইডার) কোন সম্প্রচারকারী বা ব্যবহারকারীর কাছে কর্মটি প্রচারের অনুমতি প্রদান বা তা থেকে কোন আর্থিক বা অন্যরকম উপকার (বেনিফিট) গ্রহণ করতে পারবে না। জানা গেছে, মোবাইল কোম্পানীগুলো জনপ্রিয় হওয়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কনটেন্ট প্রভাইডার প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান শিল্পী ও সুরকারদের কাছ থেকে একচেটিয়া স্বত্ব কিংবা মেয়াদভিত্তিক স্বত্ব গ্রহণ করেছে। এখন এসব চুক্তি বা ব্যবস্থাসমূহ কতখানি বৈধ, প্রয়োগযোগ্য ও আইনসম্মত, তা যাচাই করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
আইনে সঙ্গীতের সংজ্ঞা বিতর্কিত!
বাংলাদেশ কপিরাইট আইনে (২০০০, সংশোধিত ২০০৫) বেশ-কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা, অসম্পূর্ণতা ও অসঙ্গতি আছে। যে ভাষায় সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে তা যেমন ঘোরালো-প্যাঁচালো, তেমনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রদত্ত ব্যাখ্যাও পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। কিংবা এমনও হতে পারে কালের অগ্রগতির সাথে সাথে কিছু-কিছু বিষয়ের চাহিদা, কাম্যতা, পরিপ্রেক্ষিত বা প্রাসঙ্গিকতা পরিবর্তিত হয়েছে, যা আইনটি প্রণয়নের মুহূর্তে প্রণেতাদের অগোচরে ছিল। এরকম একটি বিষয় হচ্ছে সঙ্গীত। সঙ্গীতকর্ম কি? আইনের ২ নং ধারার ৩৭ উপধারায় বলা হয়েছে “সংগীতকর্ম অর্থ সুর সম্বলিত কর্ম এবং উক্ত কর্মের স্বরলিপির পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত হইবে কিন্তু কোন কথা বা কাজকে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা বা সম্পাদন করা অন্তর্ভুক্ত হইবে না;”। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংজ্ঞাটি যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি বিতর্কিত। সঙ্গীত কি শুধু সুর বা স্বরলিপি? সঙ্গীত কি কেবলি যন্ত্রসর্বস্ব? কথা বা কাজ তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে না কেন? কথা বা কাজকে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা বা সম্পাদন করা কেন সঙ্গীতকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে না? গান কি তাহলে সঙ্গীত নয়? সুর ও স্বরলিপিকে বাজানো বা গাওয়া না হলে তা সঙ্গীতে পরিণত হবে কেমন করে? নিরব সুর ও মুদ্রিত স্বরলিপি কন্ঠে বা যন্ত্রে গীত বা পরিবেশিত বা অন্যরূপে সম্পাদিত না হলে তা কোনমতেই সঙ্গীত হয়ে ওঠে না। কেননা সঙ্গীত বলতে একই সঙ্গে সুরসৃষ্টি ও তার পরিবেশনা বোঝায়।
সৌজন্যে:প্রিয়.কম
Discussion about this post