শিহাব আহমেদ সিরাজী
বয়সের বিভিন্ন সংখ্যাতত্ত্ব আইনজীবী হিসেবে প্রায়শই আমাকে ভাবিয়ে তুলতো। আমি গোলক ধাঁধায় পড়ে যেতাম। ১৩, ১৪, ১৬, ১৮, ২১ একটা থেকে আরেকটা সংখ্যার ব্যবধান/দূরত্ব/সম্পর্ক আমাকে ভাবিয়ে তুলতো। নানা যুক্তি তক্কের পরও আমি কোন একটা নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছাতে পারতাম না, আমি গোলক ধাঁধার অথৈ সাগরে সাতরাতে থাকতাম। শুধু সমাধান মিলতো না। সদুত্তর আমি বহু সুধীজন, বিজ্ঞজন, জ্ঞানীজনের সভা, সেমিনারেও হাতরিয়েছি, জিজ্ঞাসিয়াছি কিন্তু নিজেকে ধাঁধা মুক্ত করিতে পারি নাই। অতঃপর ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ আমি পেলাম তার সমাধান, আমি হলাম ধাঁধা মুক্ত, বাংলাদেশ পেল একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগোপযোগী বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ!!
এক. ১লা এপ্রিল ১৯৩০ হতে কার্যকর হওয়া বর্তমানে বিলুপ্ত শিশুবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ এর ২(ক) ধারা অনুযায়ী শিশু মানে ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোন নারীকে বোঝাবে। এই আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী বিবাহের পক্ষদ্বয়ের কোন একপক্ষ যদি শিশু হয় তবে উক্ত বিবাহকে শিশু বিবাহ বলে আখ্যায়িত করা হবে। এই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী শিশু বিবাহের শাস্তি এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড। আমার জিজ্ঞাসা ছিল তবে কি এক হাজার টাকা জরিমানা প্রদানের সামর্থ্য আর এক মাস বিনাশ্রম কারাবাস দন্ড খাটার সাহস অর্জনই ছিল শিশু বিবাহের যোগ্যতা!! অল্প বয়সী মেয়ের সাথে যৌন সঙ্গম করার জন্য এতটুকু সাহসী হওয়া খুব কি বেশি!!
দুই. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। উল্লেখ্য যে, ১৯২৯ এর শিশু নিরোধ আইন এর ২(ক) ধারা অনুযায়ী শিশু মানে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোন নারীকে বোঝাবে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ২(ট) ধারা অনুসারে শিশু অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন ব্যক্তি এবং শিশু আইন ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুসারে ১৮ বছর বয়সের নিচে সকল ব্যক্তিই শিশু। তাহলে কি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ -এ “বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের নারীর… …” কথা উল্লেখপূর্বক সুপরিকল্পিতভাবেই ঈঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে কোন না কোন ভাবে ১৬ বছর বয়সও মেয়েদের বিবাহের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স!! পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন মিলনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে!!
তিন. ম্যাজরিটি এ্যাক্ট ১৮৭৫ অনুসারে কোন বিষয়ে সম্মতি বা অসম্মতি প্রদানে কোন ব্যক্তির নূন্যতম বয়স বিবেচনা করা হবে ১৮ বৎসর। কিন্তুনারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ -এর ৯(১) ধারায় বলা হলো ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া যৌন সঙ্গম করিলে তাহা ধর্ষণ বলিয়া গণ্য হবে। এখন জিজ্ঞাসা হলো যেখানে ১৮ বছর বয়সের আগে কোন ব্যক্তি সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশের জন্য বিবেচ্যই নয়, সেখানে ১৬-১৮ বছরের বয়সী নারীদের ধর্ষণ সংজ্ঞায়িত করা হবে কিভাবে?? যদি ১৬-১৮ বছরের মধ্যবর্তী কোন মেয়েকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে যৌন সঙ্গম করা হয় তবে বিবাহটি যেহেতু সংগঠিত হয়েছে অভিভাবকের সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে, সেহেতু অভিভাবকের সম্মতির ভিত্তিতে সংগঠিত বিবাহের ধারাবাহিকতায় সংগঠিত যৌনসঙ্গমের সম্মতি/অসম্মতির দায় তো অভিভাবকের উপরই বর্তায়। তবে কি অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীর সাথে যৌন সঙ্গমের জন্য অভিভাবকের সম্মতি প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০!! আবার, যদি ১৬-১৮ বছরের মধ্যবর্তী কোন অবিবাহিত মেয়ের সাথে তার সম্মতিতে যৌন সঙ্গম করা হয় যার কিনা কোন বিষয়ে সম্মতি বা অসম্মতি প্রদানের আইনগত অধিকারই নেই। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ কি অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীকে বিশেষ আইন করে শুধুমাত্র যৌন সঙ্গমের জন্য সম্মতি প্রদানের বিশেষ অধিকার প্রদান করে!!
চার. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ২(ঙ) ধারা অনুসারে ধর্ষণ অর্থ আলোচ্য আইনের ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে পেনাল কোড ১৮৬০ (দন্ড বিধি ১৮৬০) এর ৩৭৫ ধারায় সংজ্ঞায়িত ধর্ষণের সংজ্ঞাকেই বুঝাবে। আলোচ্য আইনের ৯ ধারায় বলা আছে বিবাহ বন্ধন ব্যতিত ষোল বছরের অধিক কোন নারীর অসম্মতিতে যৌন সঙ্গম করিলে তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারার ব্যতিক্রমে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তের বছরের অধিক বয়সী তার নিজস্ব স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করলে তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না। তাহলে উক্ত বিবেচনায় বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্ষণ সংজ্ঞায়িত করতে কোন বয়সটি বিবেচিত হবে?? ১৩ নাকি ১৬?? তবে কি, যৌন সঙ্গমের বিশেষ বিবেচনায় ১৩ বছর বয়সেও নারীর বিবাহকে আইন সিদ্ধ করে দন্ড বিধি ১৮৬০!!
পাঁচ. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এর ২(১০) ধারা অনুসারে “পরিবার” অর্থ রক্ত সম্বন্ধীয় বা বৈবাহিক সম্পর্কীয় কারণে অথবা দত্তক বা যৌথ পরিবারের সদস্য হইবার কারণে যাহারা অংশীদারী বাসগৃহে একত্রে বসবাস করেন অথবা বসবাস করিতেন এদের সকলকে বুঝাইবে। এই বিবেচনায় স্পষ্টতই আমরা বলতে পারি স্বামী ও স্ত্রী পরিবারের এই সংজ্ঞার মধ্যে পরে। সুতরাং এই আইনের আওতায় যে কোন নারী তার স্বামীর দ্বারা কৃত এই আইনের যে কোন লঙ্গনের প্রতিকার চাইতে পারবেন। আলোচ্য আইনেরই ৩ ধারা অনুসারে পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রহিয়াছে এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাইবে। আমার জিজ্ঞাসা ছিল কোন স্ত্রী যদি তার নিজস্ব স্বামীর কোন কৃত কর্ম দ্বারা যৌন নির্যাতন অনুভব করেন বা যৌন নির্যাতন হয়েছে বলে মনে করেন তবে কি স্বামীর বিরুদ্ধে এই আইনে অভিযোগ উত্থাপন করিতে পারিবে?? বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশে বৈবাহিক সম্পর্কে ধর্ষণ এর স্বীকৃতি কি দেয় এই আইন!!
ছয়. এতক্ষনে আমরা জেনেছি শিশুর সংঙ্গায়নে বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন বয়সের উল্লেখ আছে। তারপরও আমরা জানি, ১৮ বছর বয়সে পুরুষ নারী নির্বিশেষে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তার ভোটাধিকার অর্জন করেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন/ ভূমিকা রাখার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহের জন্য নূন্যতম বয়স ২১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু পুরুষকে তো এই দেশে, এই সমাজে অনগ্রসর নাগরিক হিসেবেও বিবেচনায় আনা হয় না। তবে, বিবাহের ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর কোন বিবেচনায়?? রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের চেয়েও কি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জীবন সঙ্গী নির্বাচনে সম্মতি প্রদান অধিকতর কঠিন কাজ!! একবার ভেবেছিলাম এই লেখাটির শিরোনাম হওয়া উচিত “অল্প বয়সী মেয়ের সাথে যৌন সঙ্গমের আইন সিদ্ধ কয়েকটি উপায়।” অথবা “অল্প বয়সী নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গমের আগে যে আইনি বিষয়গুলো অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন।” যাই হোক, অবশেষে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর মাধ্যমে ১৮ বছরের কম বয়সী নারীদের বিশেষ বিবেচনায় বিবাহ আইন সম্মত করে নিয়ে সংখ্যা তত্ত্বের গোলক ধাঁধা থেকে মুক্ত দেয়ায় বাংলাদেশ তোমাকে অভিবাদন।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
Discussion about this post