অ্যাডভোকেট সোয়েব রহমান
জমির দখল যার কাছে আছে বা যিনি দখলে আছেন তিনি দখলে থাকবেন এটাই সাধারণ নীতি। যার দখল আছে তাকে যদি শক্তির জোরে বেদখল করার ব্যাপারে আইন সমর্থন দিত তবে সবাই বল প্রয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ত। তাই আইনে বল প্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই আইনটি করা হয়েছে। যার দখল নেই কিন্তু স্বত্ব বা মালিকানা আছে, সে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবে না। শক্তির জোরে দখলদার ব্যক্তিকে জমির দখলচ্যুত করা যাবে না। তবে স্বত্ববান ব্যক্তি বেআইনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে তার দখল বজায় রাখার জন্য আইনি সহায়তা পাবেন। স্বত্ববান ব্যক্তি প্রয়োজনে ‘দখল পুনরুদ্ধারের মামলা’ করে জবর-দখলকারকে বিতাড়িত বা দখলচ্যুত করতে পারে। সে জন্য এই আইনটি জানা থাকতে হবে স্থাবর সম্পত্তি থেকে দখলচ্যুত হলে কীভাবে প্রতিকার পাবেন।
দখল কি:
দখল বলতে সাধারণত কোন কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণকে বুঝায়৷ এ ধারার দখল বলতে বর্তমান দখলকেই নির্দেশ করা হয়েছে৷ দখল প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। তবে এমন সম্পত্তি আছে স্পষ্টতই দখল করা যায় না৷ যেমন ব্যবসায়ের সুনাম৷ এতদ্ব্যতীত দখলের আবার বিভিন্ন দিক রয়েছে-
১. Immediate possession ( তাৎক্ষণিক দখল) : যখন কেউ নিজে নিজের জন্য দখল করে রাখে, যেমন, যে বৈধ দখলদার বা মালিক।
২. Mediate possession (মধ্যবর্তী দখল) : যখন কেউ নিজে অন্য কারো হয়ে দখল করে রাখে, যেমন এজেন্ট।
৩.Incorporeal possession ( অমূর্ত দখল) : এমন কোন বিষয়ের দখল যা বাহ্যিক ভাবে/ বাস্তবে দেখা যায় না, যেমন আইনি অধিকার বা সুনাম ইত্যাদি।
৪. Constructive possession ( গঠনমূলক দখল) : যখন কেউ বাস্তবিক / প্রকৃত দখলে না থেকেও কোন কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন ধরনের দখল।
৫. Adverse possession ( প্রতিকূল দখল) : যখন কোন ব্যক্তি অন্য কারো (মালিকানাধীন) স্থাবর সম্পত্তিতে কোন ধরনের চুক্তি বা অভিযোগ ছাড়া ১২ বছর বাহ্যিক ভাবে/ বাস্তবে দখল করে থাকে তখন তা এই দখলকে Adverse possession বা প্রতিকূল দখল বলে, উল্লেখ্য এই দখলদার পরে ঐ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারে। (Article 142 of Limitation Act)
জমি দখলে রাখার অধিকার:
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এক খন্ড জমি দখলে রাখার জন্য সব সময়ই উদগ্রীব থাকে৷ জমি দখলে রাখার অধিকার বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন- উত্তরাধিকার সূত্রে, ক্রয় সূত্রে, দান সূত্রে, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত খাস জমি পাবার পর, লীজ গ্রহণের মাধ্যমে, জবর দখলের মাধ্যমে, বর্গা চাষের জন্যও জমি দখলে রাখতে পারবে৷ উপরোক্ত যে কোনো ভাবেই কোনো মানুষ জমি পেয়ে থাকুক না কেন জমি দখলে রাখার অধিকার সকল মানুষেরই রয়েছে৷ এমন কি ঐ জমিতে যদি তার মালিকানা নাও থাকে তথাপিও সেই জমি দখলে রাখতে পারবে৷
জমি বেদখল কি:
জমি বেদখল বলতে বোঝায় প্রকৃত মালিককে তার মালিকানা থেকে জোর করে উচ্ছেদ করে অবৈধভাবে সেখানে তার স্বত্তা প্রতিষ্ঠিত করা ৷
জমি বেদখল কিভাবে হয়:
জমি জমা ভোগ দখলে রাখার আশা মানুষের চিরকালের ৷ তাই জমির দখল নিয়ে সব সময়ই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে ৷ অসাধু দাঙ্গাটে প্রকৃতির লোকেরা প্রায়ই লোকজনকে জোরপুর্বক বা চাতুরী পন্থায় ভুমি বেদখল করছে
জমি হতে বেদখল হলে প্রতিকার:
জমি হতে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্বারের জন্য যে সমস্ত প্রতিকার আছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১) সালিশের মাধ্যমে
২) আদালতে মামলা করার মাধ্যমে (ফৌজদারী আদালত অথবা দেওয়ানী আদালত)
সালিশের মাধ্যমে:
কোন ব্যক্তির জমি বেদখল হলে তার গ্রামের স্থানীয় লোকদের নেতৃত্বে সালিশের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি তার জমি ফেরত পেতে পারেন ৷ সালিশে মীমাংসার মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে সমাধান করা হয়ে থাকে ৷
আদালতে মামলা করার মাধ্যমে:
যদি জমি হতে বেদখল হওয়া ব্যক্তিটি মনে করেন যে গ্রামের স্থানীয় লোকদের নেতৃত্বে সালিশের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিকার পাবেন না মর্মে আশংকা করেন কিংবা গ্রামের স্থানীয় লোকদের নেতৃত্বে সালিশে মীমাংসার মাধ্যমে কোনো সমাধান বা প্রতিকার না পান তাহলে সেক্ষেত্রে জমি হতে বেদখল হওয়া ব্যক্তিটি সরাসরি আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবেন।
কোন কোন আদালতে মামলা দায়ের করা যায়:
– ফৌজদারী আদালত অথবা
– দেওয়ানী আদালত
ফৌজদারী আদালতে মামলা:
জমি দখলকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন।
যদি কোনো ব্যক্তি তার দখলকৃত জমি হতে (মালিকানা থাক বা না থাক) হঠাত্ করে বেদখল হয়ে যান কিংবা কোনো ব্যক্তিকে জোরপূর্বকভাবে বেদখল করা হয় কিংবা বেদখল হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে উক্ত ব্যক্তি জমি হতে বেদখল হওয়া বা হওয়ার আশংকার তারিখ হতে ২ মাসের মধ্যে ১ম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে মামলা করতে পারবেন। এ ধরনের মামলা অল্প সময়ের মধ্যেই নিস্পত্তি হয়ে থাকে। (১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৫ ধারা)
১৪৫ ধারার বিশ্লেষণ:
১৪৫ ধারার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের দ্বারা প্রয়োগ করতে হবে। স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধ হতে উদ্ভুত শান্তি ভঙ্গ প্রতিরোধকল্পে ১৪৫ ধারা দখলরত যে কোন একপক্ষকে দখল বজায় রাখার মাধ্যমে দ্রুত প্রতিকারের বিধান করেছে ।
এই আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধীয় সম্পত্তির দখলে হস্তক্ষেপ করে উক্ত দখল সম্পর্কে অস্থায়ী আদেশ দিতে ম্যাজিষ্ট্রেটকে ক্ষমতা দেয়া এবং উক্ত আদেশের কাযর্কারিতা উপযুক্ত কোন আদালতের দ্বারা যে কোন একপক্ষে প্রকৃত অধিকার নিষ্পত্তি না হওয়া পযর্ন্ত বলবত্ থাকে।
তাই এই ধারায় প্রদত্ত এখতিয়ারের ভিত্তির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হচ্ছে
(১) একটি বিরোধ
(২) বিরোধটি ভূমির দখল সম্পর্কিত
(৩) উহা শান্তি ভঙ্গ করতে পারে এবং এই উপাদানগুলো বিদ্যমান আছে মর্মে ম্যাজিষ্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে তিনি হস্তক্ষেপ করার অধিকারী হন।
ফৌজদারী আদালতের এখতিয়ার খুবই সীমিত এবং উহা শান্তি ভঙ্গের প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ১৪৫ ধারার কাযর্ধারা আধা বিচারিক এবং প্রকৃতিগতভাবে আধা প্রশাসনিক। ১৪৫ ধারার কখন ও কখন ও অপপ্রয়োগ হওয়ায় দেওয়ানী বিরোধ নিস্পত্তির জন্য পক্ষসমূহ ফৌজদারী আদালতের আশ্রয় নেয় কিনা তা সতর্কভাবে ম্যাজিষ্ট্রেটকে দেখতে হয়।”বিরোধ” অর্থ ১৪৫ ধারানুযায়ী অগ্রসরের সময়ে দখলের প্রশ্নে পক্ষ সমূহের মধ্যে সত্যিকারভাবে বিদ্যমান মতানৈক্য। ম্যাজিষ্ট্রেটের দায়িত্ব হচ্ছে অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাওয়া প্রকৃত দখলে থাকা ব্যক্তির দখল ঘোষণা করা ও উক্ত দখল বজায় রাখা। ১৪৫ ধারার উপধারা (৪) এর শর্ত অনুযায়ী এই ধরনের আদেশ প্রদানের তারিখ হতে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে কোন ব্যক্তি দখলচ্যুত হলে ঐ তারিখে তিনি বিরোধীয় ভূমির দখলে ছিলেন বলে বিবেচিত হবেন ।
দেওয়ানী আদালতে মামলা:
যদি কোনো ব্যক্তি তার দখলে থাকা জমি হতে বেদখল হয়ে যায় কিংবা তাকে জোর পূর্বকভাবে তাকে বেদখল করা হয় তাহলে তিনি জমির দখল পুনরুদ্ধারের, মালিকানা বা স্বত্ব দাবির জন্য দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে হবে।জমি অবৈধভাবে দখলচ্যুত হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারেন।
উক্ত ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি তার দখলকৃত জমি হতে বেদখল হয়ে যায় এবং ঐ বেদখল হওয়া জমিটিতে তার বৈধ মালিকানা স্বত্ব থাকে তাহলে বেদখল হওয়ার ১২ বছরের মধ্যে ঐ জমিটি ফিরে পাবার জন্য দখল পুনরুদ্বার সাথে স্বত্ব ঘোষণার মামলা করতে পারবেন। (১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারা )
৮ এবং ৪২ ধারার বিশ্লেষণ:
এ আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী জমির মালিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে জমিটি পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতিকার চাইতে পারেন। তবে এ ধারা অনুযায়ী, দখলচ্যুত ব্যক্তিকে জমিতে তার
বৈধ মালিকানা বা স্বত্ব আছে কিংবা মালিকানার দাবি রয়েছে কিংবা তার জমির স্বত্ব বা বৈধ মালিকানা অস্বীকার করা হয়, তাহলে তিনি এ আইনের ৪২ ধারায় স্বত্ব ঘোষণা সহ প্রতিকার চাইতে হবে৷ ৮ ধারার সম্পত্তির মালিকানা বা স্বত্ব প্রমাণসহ দখল পুনরুদ্বার মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের মামলাকে সাধারণত স্বত্ব সাব্যস্ত খাস দখলের মামলা বলা হয়।
ধারা ৯৷ স্থাবর সম্পত্তির দখলচ্যুত ব্যক্তি কর্তৃক মামলা (Suit by person dispossed Of immovable Property):
যদি কোনো ব্যক্তি তার দখলকৃত জমি হতে হঠাত্ করে বেদখল হয়ে যান কিংবা কোনো ব্যক্তিকে জোর পূর্বকভাবে বেদখল করা হয় তাহলে জমি হতে বেদখল হওয়া ব্যক্তি বেদখল হওয়ার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে দখল পুনরুদ্বারের দাবিতে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারবেন৷
৯ ধারার বিশ্লেষণ:
ধারা-৯ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আইনগত পন্থা ছাড়া দখলচ্যুত ব্যক্তি সম্পত্তিতে তার কোন স্বত্ব (মালিকানা) থাক বা না থাক, উক্ত দখলচ্যুত স্থাবর সম্পত্তির দখল উদ্ধারের জন্য মোকদ্দমা দায়েরের মাধ্যমে তা উদ্ধার করতে পারে৷
এ ধারার বিধান হলো যিনি ভুমি হতে বেদখল হয়েছেন তাকে বেদখল হওয়ার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে মধ্যে দখল পুনরুদ্বারের দাবিতে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে৷ তবে ৯ ধারার মামলার স্বত্বের (মালিকানা) প্রশ্নটি বিচার্য হবে না৷ ৯ ধারায় মামলার প্রতিকার শুধু দখল সংক্রান্ত৷ আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্বার করা যায়৷ এমনকি বাদী যদি সম্পত্তিতে নিজের স্বত্ব (মালিকানা) প্রমাণে সমর্থ নাও হন কেবল বেদখল হওয়ার আগে পর্যন্ত দখলে থাকা প্রমাণ করতে পারেন তবেই তিনি তার পক্ষে ডিক্রী পেতে পারেন৷ সুনিদিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা মতে প্রদত্ত ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্বে আপিল বা রিভিউ করার কোন বিধান নেই৷ তবে মহামান্য হাইকোটে রিভিশন করা যাবে। কিন্ত সম্পত্তিতে প্রকৃত স্বত্ববান ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা দায়েরের কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে না। তবে সরকারের ক্ষেত্রে এ ধারার কোন প্রয়োগযোগ্যতা নেই।
এছাড়াও এই আইনের ৮ ও ৯ ধারার ক্ষেত্রে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য বাদী যদি মনে করেন, তার নালিশি জমিটি দখলকৃত বিবাদীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা হলে তিনি আদালতের কাছে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।
সর্বোপরি বলা যায় যে, জমি হতে বেদখল হওয়া ব্যক্তি যদি আদালতে মামলা করার পর তার জমি দখলে রাখার জন্য উপযুক্ত কারণ ও প্রমাণ দেখাতে পারেন তাহলে জমি হতে বেদখল হওয়া ব্যক্তিটি তার বেদখল হওয়া জমিতে পুনরায় দখল ফেরত্ পাবেন এবং দখল প্রদানের নিশ্চয়তা আদালতই করে দিবেন৷
যদি ঐ ব্যক্তি বেদখল হওয়া জমিতে তার সত্যিই মালিকানা আছে তা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আদালত বেদখল হওয়া জমিতে তার মালিকানার ঘোষণা সহ জমির দখল প্রদানের জন্য নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করবেন ৷
লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কুমিল্লা।
Discussion about this post