মুক্তা, স্বর্ণা, রুপা তারা তিন বোন। তাদের বয়স যথাক্রমে ২৫, ২২, ২০। সবার বড় মুক্তা(২৫), তার পর স্বর্ণা(২২) আর সবার ছোট রুপা(২০)। তাদের সবার ছিল আদরের একটি ছোট ভাই, সুমন। তারা কুমিল্লার বাসিন্দা। এইভাবেই চলছিল তাদের জীবন। হঠাৎ একদিন মুক্তার দাদা মারা গেল; আর সেই সুবাধে সকল আত্মীয়-স্বজন সবাই মুক্তাদের বাড়ি। কিছু আত্মীয় পরিচিত, কেউবা অপরিচিত। কিন্তু, সবার মাঝে একজন কেড়ে নিল মুক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ। একটা সুদর্শন ছেলে মুক্তার দাদার সমাধিতে ব্যস্ত ছিল। আর মুক্তা ব্যস্ত তাকে চেনার। কিন্তু, তাকে আগে কখনও দেখেছে বলে মুক্তার মনে পড়ে না। সমাধি শেষে সবাই যখন যে যার মত যার যার গন্তব্যে ফিরল তখন ঐ ছেলের সম্বন্ধে মুক্তা খোঁজ নিল। আর খোঁজ নিয়ে সে জানত ঐ ছেলে তাদের পারিবারিক আত্মীয়, ফ্রাহী। ফ্রাহী মুক্তার দাদার বন্ধুর নাতি। বিশেষ বড় কোন অনুষ্ঠান বা এমন কোন দুর্ঘটনা ছাড়া ঐ ফ্রাহীকে দেখা যায় না। তাই, এতটুকুতেই থামতে হল মুক্তাকে। চলতে লাগল এইভাবেই। কয়েকদিন পর হঠাৎ মারা গেল স্বর্ণা। স্বর্ণার সমাধিতে আসল ফ্রাহী এবং সমাধি শেষে চলে গেল। ফ্রাহীকে আবার আসতে হল রুপার সমাধিতে। কয়দিন বাদ সবাই পুরোপুরি স্তব্ধ। কেননা মারা গেল আদরের সুমনও। এই বারও সমাধিতে আসতে হল ফ্রাহীকে। কোন প্রকার রোগ কিংবা দুর্ঘটনা ছাড়াই একে একে তিনটি তাজা প্রান ঝরল, আছে আপনার কাছে কোন উত্তর। কেন ঘটল এসব, কে ঘটাল, কীভাবে ঘটল এমন প্রশ্নই পাঠকের মাথা ঘুরছে আশা করি।
আপনি হয়তো আমজনতা, কিংবা আইনের জগতে নতুন তাই কোন সমাধান নেই আপনার কাছে। কিন্তু, তাতে কি, জাতি হিসেবে আমাদের একটা গুণ/স্বভাব রয়েছে, আর তা হচ্ছে সন্দেহ। কোন একটি ক্রাইম হলেই আমরা প্রথমে একজনকে ক্রিমিনাল হিসেবে ঠিক করি, তারপর তার ঘাড়ে ক্রাইমটা বসাতে চেষ্টা করি। কিন্তু সঠিক নিয়মটা হচ্ছে, আগে ক্রাইমের ধরণটা বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ক্রিমিনালকে খুঁজতে হবে। যাই হোক, আমাদের উপরের ঘটনায় ক্রিমিনাল হচ্ছে মুক্তা। কেননা, মুক্তা ‘Love at first sight’ বাংলায় যাকে বলে ‘প্রথম দেখায় প্রেম’ ঐ লাভ থিওরিতে ফ্রাহীর প্রেমে পড়েছিল। আর যেহেতু বিশেষ বড় কোন অনুষ্ঠান বা দুর্ঘটনা ছাড়া ফ্রাহী মুক্তাদের বাড়ি আসে না, তাই প্রতিনিয়ত বিশেষ অনুষ্ঠান(নিজ ভাইবোনকে খুন) ঘটিয়ে ফ্রাহীকে তাদের বাড়িতে এনেছিল এবং নিজের চোখের তৃষ্ণা মিতিয়েছিল। এই হল মূল ঘটনা। এখন পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন কতটা নিষ্ঠুর ঐ মেয়েটি তাই না, আবার কেউ ভাবছেন মেয়েটা বোধ হয় পাগল। হ্যাঁ, তাই। পাগল আর মানসিক রোগীর মধ্যে যদি কোন পার্থক্য না থেকে থাকে তবে মেয়েটা তাই। এতটুকু পরিষ্কার যে মেয়েটি মানসিক রোগী এবং খুনি। এখন শুধু দেখার বিষয় যেহেতু এতগুলো খুন করল, সেহেতু মেয়েটি সিরিয়াল কিলার কিনা। চলুন তার আগে জেনে নিই সিরিয়াল কিলার সম্বন্ধে।
“সিরিয়াল কিলার” শব্দটি ইংরেজি শব্দ হলেও তা বাংলাতেও এই ভাবেই ব্যবহার হয়ে আসছে। সংজ্ঞার দিক থেকে একেকজন একেকভাবে দিলেও সিরিয়াল কিলার সম্বন্ধে সবার মধ্যে মূল বিষয়বস্তু একই ছিল। সহজ ভাষায় যদি সিরিয়াল কিলারের সংজ্ঞা দেওয়া হয় তবে তা হবে অনেকটা এমন যে, ‘নির্দিষ্ট সময় পর পর একই বা ভিন্ন স্থানে কোন খুনি একা বা সহযোগীসহ তিন বা তিনের অধিক খুন করে তখনই ঐ খুনি বা ঐ দলকে সিরিয়াল কিলার বলা হয়’। তবে, সংখ্যার ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। অনেকেই মনে করে দুইটি খুন হলেও তা সিরিয়াল কিলার হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে দুই খুন মীরাক্কেলেও হয়ে যেতেই পারে, তাই সংখ্যার দিক থেকে তিনটি খুনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আসুন জানি, সিরিয়াল কিলার এবং যারা খুন হচ্ছেন (ভিকটিম)দের সম্বন্ধে।
অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারই মানসিক অসুস্থ হয়, খুব কম সংখ্যার সিরিয়াল কিলার রয়েছে যারা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে। জীবনের কোন সময়ে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকেই এই ধরনের খুন করে থাকে। অর্থাৎ, কোন মর্মান্তিক ঘটনাই মূলত একজন সাধারণ মানুষের সিরিয়াল কিলার হবার উইটার্ন। আবার অনেকেই কোন কারন ছাড়াই সিরিয়াল খুন করে থাকে। এটা তাদের প্যাশনের মত কাজ করে। এই পর্যন্ত পৃথিবীতে যেই পরিমাণ সিরিয়াল কিলারদের পরিচয় পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৯০% ই পুরুষ। কিছু মহিলা থাকলেও তা খুব একটা আলোচনায় আসেনি। সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে ৯০% ই পুরুষ হলেও এদের শিকারের ৬৭%ই নারী। নারী ছাড়াও পথে শিশু, ভিক্ষুক ইত্যাদি অসহায়রাই বেশীর ভাগ সিরিয়াল কিলিং-এর শিকার। তবে, সিরিয়াল কিলার এবং তার শিকারের মধ্যে কোন রক্তে সম্পর্ক থাকে না সাধারণত অর্থাৎ তারা অনাত্মীয় (আত্মীয় নয়) হয়। নারী কিংবা পুরুষ যাকেই খুন করুক না কেন, খুনের আগে বেশীর ভাগ ভিকটিমই ধর্ষণের শিকার হয়েছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে সমকামিতার। সিরিয়াল কিলার ভেদে তাদের ভিকটিমের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তবে একই সিরিয়াল কিলারের ভিকটিমদের মধ্যে সাধারনত মিল পাওয়া যায় (যেমন অধিকাংশই নারী কিংবা শিশু বা নির্দিষ্ট বয়সের বা নির্দিষ্ট পেশার ইত্যাদি)। হত্যাকান্ডগুলো বৈষয়িক লাভের জন্য করা হয় না বরং নিজের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য করা হয়। তবে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হচ্ছে, সিরিয়াল কিলারদের আই.কিউ স্বাভাবিক মানুষদের চেয়ে কিছু বেশীই হয়ে থাকে। এরা সাধারনত অস্থিতিশীল পরিবার থেকেই বেশী আসে অথবা কোন ভালো পরিবার যখন অস্থিতিশীল অবস্থার সম্মুখীন হয় এবং তারা তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরেই সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়। অনেক সময় অনেক সিরিয়াল কিলারকে দেখে যায় শৈশবে তারা বাবা-মাকে হারিয়ে ছিল বা পিতৃ পরিত্যক্ত হয়ে ছিল বা সৎ মা সংক্রান্ত মানসিক কষ্টে ছিল। আমরা জানি, পরিবার থেকে মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। সেই ক্ষেত্রে অনেক সিরিয়াল কিলারেরই পারিবারিক অপরাধ প্রবনতা, ড্রাগ গ্রহন বা মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে। এরা নরমালি নিজ পিতা মাতাকে ঘৃণা করে। আবার অনেক সিরিয়াল কিলারদের শৈশবে শারীরিক, মানসিক ও যৌনভাবে নিগৃত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ফ্যামিলি মেম্বার দ্বারাও তারা নিগৃহীত হয়ে থাকে। আগেই বলা হয়েছে যে, সিরিয়াল কিলাররা মানসিক রোগী। এই ক্ষেত্রে কেউ পরিণত বয়সে মানসিক রোগী হয় আবার অনেক সিরিয়াল কিলারদেরই শৈশবে মানসিক সমস্যা থাকে। অনেক সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা অনেক বেশী পরিমাণে থাকে। সিরিয়াল কিলাররা সাধারনত শৈশব হতেই ভয়েরিজম (যারা গোপনে অন্যের যৌনক্রিয়া দেখে আনন্দ লাভ করে), মর্ষকামী ও ফেটিশ হয়ে থাকে। তবে, একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা কিনা নির্দ্বিধায় মানুষ মেরে যায় তারাই কিনা আগুনকে প্রচন্ড ভয় পায়। আগুনকে ভয় পেলেও সিরিয়াল কিলাররা নিরহ পশু পাখিদের অত্যাচার করে আনন্দ পায়। তবে, আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য না দিয়ে থাকতে পারছিনা তা হল, সিরিয়াল কিলাররা অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়লেও শাস্তির ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। উত্তরটা আমাদের সকলেরই জানা, কারন তারা মানসিক রোগী। তাই তাদের শাস্তির বিধান হিসেবে যা পায় তা হচ্ছে সংশোধনী। আর যার ফলে, তারা অচিরেই বেরিয়ে যায় সংশোধনী থেকে আবারও শুরু করে সিরিয়াল খুন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সিরিয়াল কিলার থাকলেও একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সিরিয়াল কিলারদের ৭৩% শ্বেতাঙ্গ, ২২% আফ্রো-আমেরিকান,৫% অন্যান্য। ইন্টারনেট থেকে এই সব দেশের সিরিয়াল কিলারদের সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা সম্ভব। তাছাড়া, হলিউডের অনেক ছবিও আছে সিরিয়াল কিলারদেরকে নিয়ে। Psycho (1960), Henry: Portrait of a Serial Killer (1986), The Silence of the Lambs (1991), Halloween (1978), Man Bites Dog, The Hitcher (1986), Monster (2003), The Killer Inside Me (2010), Child’s Play, Plastic আপনি চাইলে এই ছবিগুলো দেখে সিরিয়াল কিলার সম্বন্ধে জানতে পারেন। তাছাড়া, কলকাতার একটি বিখ্যাত ছবি রয়েছে সিরিয়াল কিলার নিয়ে, প্রসেনজিৎ অভিনীত ‘২২ শে শ্রাবণ’। একজন সিরিয়াল কিলার কেন, কীভাবে সিরিয়াল কিলার হয় এবং তার পরিণতি প্রায় সবই এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে। আজ এতটুকুই, আশা করি পাঠক উপরের সকল তথ্য থেকে সিরিয়াল কিলার সম্বন্ধে অনেক কিছুই অনুধাবন করতে পেরেছেন। আর তাই পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখেই শেষ করছি, বলুন মুক্তা কি সিরিয়াল কিলার ?
লেখকঃ তানভির চৌধুরী
Discussion about this post