আইনজীবীদের সমন্ধে সমাজে নানারকম কথা প্রচলিত।যেমন, Lawyer মানেই Liar ,যার নাই কোন গতি সে করে উকালতি,বটতলার উকিল ইত্যাদি । আইনজীবীদের ব্যাপারে অনেকে এরকম সরলীকরণও করে থাকেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ব্যাপারটা ঠিক। বাস্তবেই এমন বহু আইনজীবী আছেন, যারা ঘটনাকে বিকৃত করেন এবং আইনের সঠিক বিধানটি উল্লেখ না করে আদালতকে বিভ্রান্ত করেন। আবার কোনো কোনো আইনজীবী তাদের মক্কেলদের মিথ্যা আশ্বাস পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- “গুটিকতক Lawyer এর এহেন গর্হিত দুষ্কর্মের জন্যে পুরো আইনজীবী সমাজকেই কি ‘Liar’ আখ্যা দেওয়া উচিত?”
‘Individual person has individual responsibility’- কোনো ব্যক্তি বিদেশে অপরাধ করলে কি সেই ব্যক্তি দায়ী না হয়ে পুরো সমাজ বা দায়ী রাষ্ট্র হয়ে যাবে? একইভাবে কোনো আইনজীবী মিথ্যা বললে কি সকল আইনজীবী বা পুরো আইন পেশাকেই দায়ী করা যাবে? সকলেই একমত হবেন যে, চিকিৎসা পেশার মূলমন্ত্র ‘সেবা’। অথচ সেই মহান পেশাতে নিয়োজিত কতিপয় ব্যক্তি আজ অসহায় মানুষের জন্যে কতটা বৈরি আর ভয়ঙ্কর হয়ে হয়ে উঠেছেন! তাই বলে কি চিকিৎসক আর চিকিৎসা পেশাকে কসাই ও কসাইগিরি বলে সরলীকরণ করা উচিত? শিক্ষকতা এক মহান পেশা । কতিপয় অনৈতিক মানুষের কারনে কি পুরো পেশাকে অনৈতিক বলা ঠিক হবে ? চলুন একটি গল্প শোনা যাক।
সৌরভ, বাবা মায়ের অতি আদরের একমাত্র সন্তান। তার পরিবারটি সুখে ভরপুর। কিন্তু বিধি বাম! কী ভাগ্য নিয়ে সে এসেছিল যে পাঁচ বছর বয়সেই তাকে মাতৃ-পিতৃহীন হতে হলো। অসহায় দিন যাপন করতে লাগল এই ছোট্ট ছেলেটি। আর এদিকে তার বাবার বিশাল সম্পত্তির ওপর নজর পড়ল তারই আপন চাচা নাজিমউদ্দিনের। চাচা তাকে যে করেই হোক ঘরছাড়া করবেনই। নানা ফন্দি তার মাথায় আসে। অবশেষে জোরপূর্বক তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় আর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করে নেয়।
এদিকে অল্প বয়সে মাতৃ-পিতৃহীন এই অবুঝ-অসহায় নিষ্পাপ ছেলেটির ঠাঁই হলো রাস্তায়। যে ছেলেটি প্রতিদিন স্কুলে যেত বই হাতে নিয়ে, আজ তার হাতে ভিক্ষার থলে। বাড়ি থেকে বাড়ি, রাস্তা থেকে রাস্তা যখন সে ভিক্ষা করতে যায়, তখন তার বন্ধুরা স্কুলে যায় বই নিয়ে। হৃদয় তার ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। অসহায় মানবতার করুণ আর্তনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় আকাশে বাতাসে। বাতাস থেমে যায় তার স্বাভাবিক বয়ে চলা থেকে, পৃথিবীর আলো যেন নিভে যায়। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, কোনো উপায় না পেয়ে হন্যে হয়ে সে ঘুরে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায়। তার স্বপ্নগুলো কেমন যেন নিঃশ্বেষ হয়ে যেতে থাকে।
দু’দিন যাবত তার কোনো খাবার নেই। দাঁড়ানোর শক্তি পর্যন্ত সে হারিয়ে ফেলে। ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে সে পার্শ্ববর্তী এক রুটির দোকানে রুটি চায়। কিন্তু দোকানি তাকে রুটিতো দেয়ই নি, বরং বার বার রুটি চাওয়ায় ছোট্ট এই নিষ্পাপ ছেলেটিকে মেরে চুরির অপবাদ দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
এক মাস যাবত সৌরভ পৃথিবীর আলো বাতাসহীন এক আবদ্ধ কুঠুরীতে সারাক্ষণ বাবা মায়ের কথা ভেবে কান্নায় বুক ফাটায়। ছোট্ট এই অবুঝ শিশুটির কান্নায় বাতাস যেন ভারি হয়ে ওঠে।অতঃপর একদিন একটি ‘মানবাধিকার সংগঠন’ তার সন্ধান পায়। অনেক কষ্টে তারা তার জামিনের ব্যবস্থা করে। সে আবার দেখতে পায় পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য।
এই সংগঠনটিতে কাজ করে ২০ জন বিজ্ঞ আইনজীবী। তারা সৌরভের কাছ থেকে জানতে পারে সেই নির্মম ও হৃদয়বিদারক কাহিনী। অতঃপর তারা সেই সম্পত্তি উদ্ধারকল্পে মামলা দায়ের করে কোর্টে। বিজ্ঞ আদালত তার সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে রায় দেন তার পক্ষে। ফলে সম্পত্তি তার দখলে আসে।
মসজিদ থেকে কিছুক্ষণ আগে আজানের আওয়াজ ভেসে এলো। পাখির কিচির-মিচির শব্দে ঘুম ভাঙল সৌরভের। নামায পড়ে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করে যেন বড় হয়ে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হতে পারে। আর ফিরিয়ে দিতে পারে অসহায়-দুখী মানুষের অধিকার।
সৌরভ আজ স্কুলে যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে। মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় আজ সে স্বাধীন। অভাবের সেই তীব্র যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট আজ আর নেই। মুক্ত মনে আজ সে পড়াশোনা করছে। আজ সে সুখী। প্রশ্ন জাগে তাহলে, Lawyer মানে কি Liar ???
লেখকঃ এম.ডি.মনির, রিসার্চ অফিসার ,বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব ল এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া)
Discussion about this post