নাজিম মৃধা:
প্রতি বছর ৩১ মে “বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস” ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করা হলেও ধূমপান বিরোধী আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রতিবছর আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ধূমপান বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবি ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ধুমপান বিরোধী আইনকে আরও জনমুখী করে সংশোধন আনেন। যা গত এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখ সংসদে পাশ হয়। সংশোধিত আইনে প্রকাশ্য স্থানে ধূমপানের জরিমানা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৩০০ করাসহ আরও গণমুখী করা হয়। কিন্তু ধূমপান বিরোধী নানা পদক্ষেপ ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হলেও কার্যক্ষেত্রে দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।
ফলে দেশে ধূমপায়ীর বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ শতাংশে, অথচ গত বছর এ সংখ্যা ছিলো ৪১ শতাংশে। ‘ক্যাম্পেইন ফর ক্লিন এয়ার’ নামের একটি জরিপ প্রতিষ্ঠান সামপ্রতিক জরিপে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়। জরিপের সবচেয়ে আশংকার বিষয় হল গত এক বছরে কিশোর ও তরুণ ধূমপায়ীর সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়ে ৫৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিশোর ও তরুণ ধূমপায়ীর ৯৮ শতাংশই সিগারেট পান করে। আর মাত্র ২ শতাংশ বিড়ি পান করে। ধূমপান হিসেবে সিগারেট ব্যবহার করায় স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুকির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কিশোর ও তরুণ সমাজ।
আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও পাবলিক প্লেস-এ ধূমপান করেও ৯৫ শতাংশ ধূমপায়ীকে একবারও জরিমানা দিতে হয়নি। উল্টোদিকে মিডিয়ায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন বন্ধ থাকলেও ধূমপায়ীর হার বাড়াতে কম দামের সিগারেটের সঙ্গে তামাকজাত পণ্যের কোম্পানিগুলো কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
আজকের এ দুর্দশার জন্য দায়ী আইনের যথার্থ প্রয়োহীনতা। আর আইনের প্রয়োগহীনতার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আইনে ধূমপানের জরিমানা ও জরিমানাকারীর সংগা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও তার কিছুই কার্যকর নেই। ফলে সংশোধন এনে আইনকে গণমুখী করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকারিতা পৌছেছে শূন্যের কোটায়।
আইনে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটের অর্ধেকজুড়ে ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণের বিধান রাখাসহ তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোনো উপায়ে বিজ্ঞাপন প্রচারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এ লাখ টাকা অর্থদন্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে। আগের আইনে কারাদন্ডের পাশাপাশি এক হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান ছিল।
নতুন আইনে অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ১৮ বছর বয়সের নিচে কারো কাছে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না বা তাদেরকে বিক্রি অথবা বিতরণ কাজে নিয়োজিত করতে পারবে না। বিধান লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হলেও দিন দিন ১৮ বছরের নিচের বয়সের কিশোর-তরুণ ধূমপায়ী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আইনের প্রয়োগহীনতারই প্রতিফলন।
সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেস বা পরিবহনের মালিক অথবা তত্ত্বাবধায়ককে সংশ্লিষ্ট এলাকা ধূমপানমুক্ত রাখার জন্য দায়বদ্ধ করা হলেও তার বিন্দুমাত্র কার্যকারিতা না থাকায় ধূমপায়ীদের সবচেয়ে বেশী দৌরাত্ব থাকে এ জায়গাগুলোতেই।
আইনে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় কোনো কাজের পৃষ্ঠপোষকতাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার বিধান রাখা হয়েছে। যেখানে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ২ শতাধিক সাংসদের আসন্ন বাজেটে বিড়ির শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারসহ সুবিধা দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রণালয়কে দেয়া একটি আধা সরকারি পত্র সত্যিই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বিড়ি শিল্পকে একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও হাজার হাজার গ্রামীন নারীর কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে দেখিয়ে তারা যে খুড়া যুক্তি দিয়েছেন তার বিপরীতে আমার প্রশ্ন হল ক্ষতিকারক বিড়ি শিল্পকে বাচানোর কথা না বলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মত ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে রক্ষা ও বিস্তার ঘটিয়ে গ্রামীণ নারীর ভাগ্যোন্নয়ন করার চিন্তা কেন আপনাদের মাথায় আসেনা? যদি এই সব সাংসদদের খুড়া যুক্তি মেনে নেয়া হয় তাহলে কোথায় থাকবে আইনে উল্লেখিত তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় কোনো কাজের পৃষ্ঠপোষকতাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার বিধান?
আইনের কিছু দূর্বলতা হল ধূমপানের জন্য নির্ধারিত জোন রাখার বিধান করা হয়েছে। এছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মামলার সুযোগ রাখা হয়নি। পুলিশ ধূমপানের জন্য জরিমানা করতে পারবে না। শুধু নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ গঠন করে তাদের হাতে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে যা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আইনে গুল, জর্দ্দা, খৈনি ও সাদাপাতার মতো ধুয়ামুক্ত দ্রব্য চোষণ ও চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করাকেও ধূমপানের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এ বিষয়ে ধূমপায়ীদের ধারণা দেয়া সম্ভব হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মারা যাচ্ছে, তিন লাখ ৮২ হাজার জন কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। ধূমপান জনিত প্রধান ৮টি রোগের চিকিৎসা বাবদ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
আশার বিষয় হলেও দেরিতে হরেও বর্তমান সরকার তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে তামাক আইন আগের চেয়ে কঠোর করেছে। যা দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। সরকারের উচিত তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চ কর নির্ধারণ করা হয় তবে সরকার বেশি রাজস্ব পাবে। অন্যদিকে ধূমপায়ীর সংখ্যাও কমবে। কিন্তু সেজন্য আইনের বাস্তবায়ন দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারে কিছু অসাধু লোক ও তামাক কোম্পানিগুলোর নানারকম ষড়যন্ত্র রুখতে সরকার এবং তামাক ও ধূমপানবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলিকে সজাগ থাকতে হবে।
একইসঙ্গে আইনের কার্যকর বাস্তবায়নে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনকেও একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুবা কাগজে লেখা আইনের বিধানগুলি যে ঘুণে ধরে যাবে বাস্তবে ফলাফল হবে শূন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: শিক্ষার্থী,আইন বিভাগ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: nazimlawru@gmail.com
যোগাযোগ: ০১৬৮৪-১৫১১৪১
Discussion about this post