অতনু সাগরঃ
সাদ্দাম হোসেন। পরপর দুইবারের বিজয়ী চেয়ারম্যান। এলাকায় বেশ সুনাম তার। সবাই তাকে এক কথার মানুষ হিসেবে চেনে। নিজ এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিত প্রান তিনি। দিন নাই রাত নাই, সর্বসময় সে ব্যস্ত থাকে এলাকার ভালো কিছু করবার আশায়। তার মত এমন নিবেদিত প্রাণ মানুষ আজ কাল দেখাই যায়না। শুধু সুনামের মধ্যেই তার পরিচয় সীমাবদ্ধ নেই। গোটা এলাকায় তার প্রভাবও বেশ ব্যপক। বলা যায় তার কথায় ওঠে বসে এমন মানুষের অভাব নেই এই এলাকায়। আর এমন মানুষ থাকবেনাই বা কেন। সাদ্দাম চেয়ারম্যানের হাতে যে সারা এলাকা বেহেস্তের মত নিরাপদ এটা সবাই জানে।
তবে একটা কথা ঠিক, ভালো মানুষের শত্রুর অভাব হয়না। সাদ্দাম সাহেবেরও তাই। তিনি ভালো করেই জানেন তার চারপাশের এত ভক্তদের মাঝেই লুকিয়ে আছে তার কোন না কোন শত্রু। যে শত্রু মনে মনে তাকে শেষ করে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে সুযোগ খুঁজছে। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে সে।
তবে এসবে ভয় পাননা তিনি। তিনি জানেন মানব সেবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই হচ্ছে বিভিন্ন অদৃশ্য শত্রুদের মোকাবেলা করা। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন ঘটে গেল চরম ঘটনা। তিনি কোনদিন কল্পনাই করেনি যে এমন কাজ তাকে করতে হবে। যাই হোক ঘটনাটা বলিঃ
রাত ১১.৩০ বাজে। মহল্লার এক সালিশ শেষ করে বাসায় আসছিলেন চেয়ারম্যান। সাথে তারই হাতে গড়ে ওঠা গ্রাম পুলিশ হাবিব মন্ডল। চেয়ারম্যানের বাড়ি আর সেই মহল্লার মাঝে একটা বিশাল আবাদী মাঠের ফারাক। মাঠের মাঝ দিয়ে মাঝারি আকারের একটা রাস্তা। পিচ দিয়ে পাকা করা। চেয়ারম্যানই এই রাস্তাটা বানিয়েছেন।
রাস্তার মাঝামাঝি আসতেই হাবিব মন্ডল চেয়ারম্যানের সামনা সামনি দাঁড়ালো। কোমড়ের ভাঁজ হতে একখান ছুরি বের করে বলল, “চাচাজান, অনেকদিন তো চাকরগিরি করলাম আপনার। আর কত। এবার এক লাফে বড়লোক হতে চাই।”
চেয়ারম্যান সাহেব হতভম্ব। এই হাবিবরে তিনি ল্যাংটাকাল থেকে বড় হতে দেখেছেন। নিজের ছেলের মত মানুষ করেছেন। তার মুখে চাচাজান ডাক শুনলে বুকটা ভরে ওঠে। অথচ সেই আজ তার বুকে ছুরি তুলেছে? মৃত্যুকে কখনো ভয় করেননি তিনি। আজও পেলেননা। শুধু ঠান্ডা মাথায় জানতে চাইলেন, কে তাকে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখিয়েছে?
জবাবে হাবিব জানাল, “সালাম বেপারী তাকে ১ লক্ষ টাকা দিবে বলেছে।”
মাথায় পুরো আগুন জ্বলে গেলো চেয়ারম্যান সাহেবের। এই সালাম বেপারী তার এলাকায় হেরোইনের, ফেন্সিডিলের ব্যবসা খুলতে চেয়েছিল। তাকেও ভাগ দেবে বলেছিল। কিন্ত তিনি চুড়ান্ত অপমান করে বের করে দিয়েছিলেন তাকে বাড়ী থেকে। আর আজ সেই সালাম হাত করেছে এই হাবিবকে? আর হাবিব তার পিতৃসম চাচাজানকে মারতে মাত্র এক লক্ষ টাকার লোভে ছুরিও বের করেছে। তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল সাদ্দাম চেয়ারম্যান ও হাবিব মোল্লার মাঝে।
যুবক বয়সে এলাকায় কাবাডি, ফুটবলে সবসময় প্রথম সাড়িতে থাকা এই চেয়ারম্যানের রক্ত আজ গরম হয়ে উঠল। নিজের শরীরে বেশ কয়েকটা হালকা ছুরির পোঁচ তার মনের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। প্রচন্ড জোড় খাটিয়ে একবার উপরে তুলে আছড়ে ফেললেন হাবিবের হালকা পাতলা দেহটিকে। মট করে একটা শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। সেই সাথে হাবিবের গগনবিদারী চিৎকার। এরপর সব চুপ হয়ে গেল। কোনদিকে না তাকিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে কোন মতে বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগলেন চেয়ারম্যান।
পরদিন হাবিবের লাশ খুঁজে পাওয়া গেলো। ঘাড় মটকে গেছিল বেচারার। এলাকার সর্বসম্মানীয় চেয়ারম্যান সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের আহত শরীর সহ আত্মসমর্পন করলেন থানার পুলিশের কাছে।
ঘটনা মোটামুটি এই। এখানে আমরা একটা বিষয় শিউর হলাম যে, গ্রাম পুলিশ হাবিবকে চেয়ারম্যান নিজের ইচ্ছায় খুন করেননি। করতে বাধ্য হয়েছেন, কারন এই খুন না করলে তিনি নিজে খুন হয়ে যেতেন। আমাদের চলমান জীবনে আমরাও এমন পরিস্থিতিতে পড়তেই পারি। এমন অনাকাংখিত ঘটনাও আমাদের দ্বারা ঘটে যেতে পারে। এবার আসুন চেয়ারম্যানের এমন আত্মরক্ষাজনিত খুনের ব্যাপারে দেখি আইন কি বলে?
আত্মরক্ষার অধিকারঃ আত্মরক্ষার অধিকার বলতে নিজের দেহ ও সম্পত্তি অন্যের আক্রমন থেকে রক্ষা করার অশিকারকে বোঝায়। তবে এ অধিকার একেবারে অবাধ বা নিরঙ্কুশ নয়। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে প্রত্যেকেরই অবৈধ হস্তক্ষেপ বা আক্রমনের হাত থেকে নিজের দেহ ও সম্পত্তিকে রক্ষা করবার অধিকার রয়েছে। এরূপ অধিকারকেই দণ্ডবিধিতে আত্মরক্ষার অধিকার বলা হয়।
দণ্ডবিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় বলা আছে,
(১) নিজের এবং অন্যের দেহ ও সম্পত্তি রক্ষা করবার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তিরই রয়েছে।
(২) এরূপ প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি যতখানি আঘাত অন্যকে বা আক্রমনকারীর উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রয়োজন তা বিনা দ্বিধায় দিতে পারেন।
অর্থাৎ জীবনের উপর মারাত্মক আঘাত আসলেই প্রত্যাঘাতের অধিকার জন্মে। তাই দন্ডবিধির ৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আত্মরক্ষামুলক অধিকার প্রয়োগকালে কৃত কোন কাজই অপরাধ বলে গণ্য হবেনা।’
দণ্ডবিধির আওতায় অধিকার প্রয়োগঃ
দণ্ডবিধির ১০২ ধারায় বলা হয়েছে,
‘দেহের ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার, অপরাধ সংঘটিত না হয়ে থাকলেও উক্ত অপরাধ সংগঠনে উদ্যোগ বা ভীতি হতে দেহ বিপন্নকারী যুক্তিযুক্ত আতঙ্ক সৃষ্টি হবার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয় এবং যতক্ষন পর্যন্ত আতঙ্ক অব্যাহত থাকে ততক্ষন পর্যন্ত উক্ত অধিকার অব্যাহত থাকে।’
অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অধিকার প্রয়োগঃ
দণ্ডবিধির ৯৮ ধারায় বলা আছে,
‘যখন কোন কার্য যা প্রকারান্তে একটি বিশেষ অপরাধ বলে গণ্য হত তা উক্ত কার্য সম্পাদঙ্কারী ব্যক্তির তারুণ্য অপরিণত বিবেক, অপ্রকৃতিস্থতা বা প্রমত্ততার কারণে অনুরূপ অপরাধ বলে গন্য হয়না, তখন প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যটি অনুরূপ অপরাধ বলে গণ্য হবার বেলায় উক্ত কার্যের বিরুদ্ধে যদরুপ ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার থাকত তদরুপ ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার থাকবে।’
নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অধিকার প্রয়োগঃ
দণ্ডবিধির ১০৬ ধারায় বলা আছে,
“যুক্তিযুক্তভাবে মরণভীতি সৃষ্টি করে এরূপ আক্রমনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষক যদি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যে কোন নিরপরাধ ব্যক্তির প্রতি ক্ষতিসাধনের ঝূঁকি না নিয়ে তিনি অনুরূপ অধিকার কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করতে পারেননা, তাহলে উক্ত ঝুঁকি নেবার প্রতিও তার ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার প্রযোজ্য হবে।”
আত্মরক্ষার জন্য অপরের মৃত্যু ঘটানোর অধিকারঃ নিজেকে রক্ষা করার জন্য আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে আক্রমণকারীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানোর অধিকার আইন স্বীকৃতি দিয়েছে। যে যে অবস্থায় এরকম মৃত্যু ঘটালে তা দণ্ডনীয় হয়না তা দন্ডবিধির ১০০ ধারায় বর্ণিত হয়েছে।
দণ্ডবিধির ১০০ ধারায় বলা হয়েছে,
“৯৯ ধারায় আরোপিত নিয়ন্ত্রন সাপেক্ষে, দেহরক্ষার প্রয়োজনে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে স্বেচ্ছাক্রমে আক্রমন কারী প্রতিপক্ষের মৃত্যু ঘটানো বা অন্য যে কোন ক্ষতি সাধন করা যেতে পারে, যদি সে অপরাধটির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং সে অপরাধটি যদি নিম্নোক্ত বিভিন্ন ধরনের মধ্যে যেকোন এক ধরনের হয়। যথাঃ
(১) এমন আঘাত,যার ফলে ন্যায়সঙ্গতভাবেই এমন আশংকার সৃষ্টি হয় যে, তাতে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকারের অবাধ প্রয়োগ না করলে সে আঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তির আসন্ন মৃত্যু অনিবার্য।
(২) এমন আঘাত বা আক্রমন, যার ফলে ন্যায়সঙ্গতভাবেই এমন আশংকার সৃষ্টি হয় যে, সে আঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তির গুরুতর আহত হওয়া অনিবার্য।
(৩) ধর্ষনের উদ্দেশ্যে আঘাত বা আক্রমন।
(৪) অস্বাভাবিক কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আঘাত বা হামলা।
(৫) শিশু অপহরণ বা ব্যক্তি হরণের উদ্দেশ্যে হামলা বা আঘাত।
(৬) কোন ব্যক্তিকে অন্যায় বা বেআইনীভাবে আটক করার উদ্দেশ্যে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যে পরিস্থিতিতে ন্যায়সঙ্গতভাবেই আক্রান্ত ব্যক্তির মনে এরকম আশংকার সৃষ্টি হয় যে, সে মুক্তির জন্য সরকারী কর্তৃপক্ষের আশ্রয় নিতে সমর্থ হবেনা।”
আত্মরক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধঃ দণ্ডবিধির ৯৬ ধারায় ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৯৭ ধারায় দেহ ও সম্পত্তি রক্ষায় ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।
আবার এসব অধিকারের অপব্যবহার যাতে না ঘটে সেজন্য যেসব কাজের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার নেই তা ৯৯ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বর্ননা করে দেওয়া হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে,
“সঠিক বিচারে আইনসঙ্গত না হলেও কোন সরকারী কর্মচারী তাঁর পদমর্যাদাবলে সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোন কাজ করলে বা করার চেষ্ঠা করলে তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রযোজ্য হবেনা। যদি সরকারী কর্মচারীর ঐ কাজে বা কাজের প্রচেষ্ঠায় ন্যায়সঙ্গতভাবে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আশংকা দেখা না দেয়।
সঠিক বিচারে আইনসঙ্গত না হলেও কোন সরকারী কর্মচারী সরকারী পদমর্যাদাবলে ও আন্তরিক সদিচ্ছাপ্রণোদিতভাবে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী কোন কাজ করার প্রচেষ্ঠার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অধিকার প্রযোজ্য হবেনা। যদি সরকারী কর্মচারীর নির্দেশানুসারে সম্পন্ন কাজটিতে বা কাজ করার প্রচেষ্ঠায় ন্যায়সঙ্গতভাবে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আশংকা দেখা না দেয়।
যেসব ক্ষেত্রে সরকারী কর্তৃপক্ষের আশ্রয় নেবার সুযোগ ও সময় থাকে, সে সব ক্ষেত্রে কোনোরূপ আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকারটি তা থেকে বিশেষ ক্ষতিসাধনে প্রযোজ্য হবে।”
অর্থাৎ নিজেকে রক্ষার বিকল্প কোন উপায় থাকলে আত্মরক্ষার এই অধিকার প্রযোজ্য হবেনা। তারপরও কেউ এই অধিকার ব্যবহার করলে সে আইনের চোখে অপরাধী হয়ে যাবে।
সমাপনী মন্তব্যঃ উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা বুঝতে পারলাম যে, নিজেকে রক্ষা করতে আমাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছে। আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই অধিকারের প্রচন্ডরকম অপব্যবহার চলছে। নিজেই নিজের ক্ষত সৃষ্টি করে অন্যকে খুন বা হত্যা অথবা অন্যের সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করবার প্রয়াস চালাচ্ছে। আমাদের সম্মিলিতভাবে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। আর এজন্য আমাদের সর্বপ্রথম জানা উচিত এর সম্পর্কে বিষদ আইন এবং আইনের প্রয়োগ।
“আসুন আমরা আইনকে জানি। সমস্ত ঘৃন্য অপরাধীদের হাত থেকে রক্ষা করি আমাদের মা-মাটি এই বাংলাদেশকে, আমাদের সমাজকে, আমাদের ভবিষ্যতকে”।
লেখকঃ আইনের ছাত্র, ইমেইল- otonushagor@gmail.com
Discussion about this post