এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যার মামলা করার লোকাস স্টান্ডি রয়েছে, তিনি জনস্বার্থে মামলা করতে পারেন। ধরুন, নদী তীরবর্তী কিছু লোক অবৈধ দখলদার হয়ে পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। এতে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
নদীর প্রকৃত গতিপথ ঠিক হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে জনস্বার্থে আপনি মামলা করতে পারেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়
জনস্বার্থমূলক মামলার রায় বাস্তবায়ন আমাদের দেশে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
‘জনস্বার্থমূলক মামলা’ কথাটি প্রথম ব্যবহার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। ভারতে হাইকোর্টে বিচারক সংখ্যা ও একজন অতিরিক্ত বিচারকের চাকরি সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে একদল আইনজীবী একটি মামলা করেন। ‘এসপি গুপ্ত বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ মামলায় ওই আবেদনকে আদালত জনস্বার্থমূলক মামলা বলে আমলে নেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে ’বেনজির ভুট্টো বনাম ফেডারেশন অফ পাকিস্তান’ মামলাটিকে সে দেশের আদালত জনস্বার্থমূলক মামলার প্রথম নজির হিসেবে মনে করে থাকেন। ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশেও জনস্বার্থমূলক মামলার প্রতি দিন দিন প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। মূলত বাংলাদেশে ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ বা ফ্যাপ-২০ মামলার রায়ে আদালত প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেন, যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যার মামলা করার লোকাস স্টান্ডি রয়েছে, তিনি জনস্বার্থে মামলা করতে পারবেন।
এ আদেশে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, খাদ্যের মান বজায় রাখা, ফুড কোর্ট স্থাপনসহ কয়েক দফা জনস্বার্থ নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। চূড়ান্ত শুনানী শেষে ২০০৯ সালের ২০ জুন হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত গঠন এবং খাদ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগের নির্দেশ সংক্রান্ত একটি রায় দেন। তবে দুঃখের বিষয় আজো তা বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই।
অন্যদিকে জনস্বার্থে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি একটি রিট আবেদন করে। ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট যৌন হয়রানি রোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদে এর বিরুদ্ধে কোনো আইন তৈরি না হওয়ার আগ পর্যন্ত এ নীতিমালা মেনে চলতে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এ রায় আজো বাস্তবায়ন হয়নি।
ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য সাজসরঞ্জাম সংগ্রহে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর কমিটি গঠন করা হলেও কোনো সাজসরঞ্জাম ক্রয় করা হয়নি আজো।
হাইকোর্ট ঢাকার চার নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুকে বাঁচাতে এক রায় প্রদান করেন। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা ও বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারি শিল্প সাভার শিল্পাঞ্চলে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের এ রায় আজো বাস্তবায়ন হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেয়া ভাষণের স্থান ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী স্থাপনসহ সব ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ করতে হবে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক এরকম রায় ঘোষণা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সে রায়ও ঝুলে রয়েছে।
বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধে একটি অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করতে এবং সিসিটিভি স্থাপনসহ জনস্বার্থে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন হাইকোর্ট। এ রায়টিও বাস্তবায়ন হয়নি।
পাশাপাশি হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এক সুয়োমোটো রুলের নিষ্পত্তি করে ঘোষিত এক রায়ে বলা হয়, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৫৩-এর ৮৫ ধারার অষ্টম তফসিলে বর্ণিত গতিসীমা অনুযায়ী সব মোটরযানের গতি সীমিত রাখার জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গতি নিয়ন্ত্রণের আইন না মানা হলে এবং গতিসীমা বহির্ভূতভাবে গাড়ি চালালে মোটর ভেহিকলস অর্ডিন্যান্সের ১৪২ ধারা অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করতে হবে। সে রায় বাস্তবায়নও সুদূরপরাহত।
এভাবে উচ্চ আদালতের দেয়া রায় দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারকে কথায় নয় বরং কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে তারা রায় বাস্তবায়নে আগ্রহী। পাশাপাশি সরকারের বিকল্পের সন্ধান করা দরকার। বিশেষ করে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে সরকারের পৃথক সেল তৈরি করা উচিত। যাতে জনস্বার্থে প্রদত্ত রায়ের মধ্যে কোনগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা খতিয়ে দেখতে ওই সেল কাজ করতে পারে।
Discussion about this post