সাম্প্রতিক সময়ে আইন অঙ্গনে একরকম ভাইরাল ইস্যু হচ্ছে লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা মওকুফ করে করোনা ভাইরাস এর
কারনে গেজেট করে সনদ চাই। যদিও চাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও গভীরভাবে উপলব্ধি করলে দীর্ঘদিন
আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও শিক্ষানবিস তকমা লাগিয়ে বেকার বসে থাকা হাজার হাজার শিক্ষানবিস
আইনজীবী ছাড়া আর কেউ তাদের বুকভরা কষ্ট অনুমান করতে পারবেন না। এ যেন খোলা আকাশে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক কে
একটি আইনের খাঁচায় বন্দি করে রাখা।
বাংলাদেশ এ এডভোকেট তালিকাভুক্তির ও সনদ প্রদানকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। কিন্ত অত্যন্ত
কস্টকর ও নিগুঢ় সত্যটা হচ্ছে বিগত ২০১৫ সালের পর থেকে বার কাউন্সিল নিয়মিত আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষা গ্রহন
করছে না ফলে হাজার হাজার আইনে স্নাতক, সম্মান, ব্যারিস্টার, এল এল বি পাশ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন যাবত তালিকাভূক্তির
পরীক্ষা না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এবার ২০১৭ ও ২০২০ সালে এম সি কিউ উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশ
আইনজীবীরা লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা মানবিক দিক বিবেচনায় মওকুফ করে সরাসরি গেজেটের মাধ্যমে এডভোকেট
ঘোষণা চেয়ে আন্দোলন এবং অনশন করছে।
তাদের আন্দোলন যৌক্তিক না অযৌক্তিক এই প্রসংগে আমি কিছু বলতে চাই না কারন গেজেট পাওয়া এবং তা প্রদান করা
সম্পুর্নরুপে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং এম সি কিউ উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের মধ্যকার বিষয় এখানে অন্য যে
কোন ব্যাক্তির অভিমত অপ্রাসংগিক।
তবে আমি অন্যান্য কিছু সার্কভুক্ত রাস্ট্র ও বাংলাদেশ এর এডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষা এর পদ্ধতি আপনাদের সামনে
তুলে ধরবো।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সংক্ষেপে সার্ক) দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সংস্থা। এর সদস্য দেশগুলো
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান। গণচীন ও জাপানকে সার্কের পর্যবেক্ষক
হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। সার্ক ১৯৮৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সার্ক প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে যেন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক,অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল
দেশসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা একই রকম থাকে। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কেরসদস্য পদ লাভ করে
এবং নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডুতে সার্কের সদর দফতর অবস্থিত । যেহেতু সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে
সামাজিক ,অথনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নের ধারা যেন একই রকম থাকে এই উদ্দেশ্যে তাই তাদের এডভোকেট
এনরোলমেন্ট পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে ধরছি-
ভারত-
ভারতে আইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া থেকে পরিচালিত ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আইনে স্নাতক করতে হয়।
এ লেভেলে/ আই এস সি তে নূন্যতম ৫০ শতাংশ নম্বর থাকলে একজন ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই
পরীক্ষাটির নাম All India Law Entrance Test (AILET)। এই পরীক্ষাটি পাস করার পর শিক্ষার্থী মেধাক্রম অনুযায়ী
ভারতের যে কোন পাবলিক+ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ৫ বছরের ডিগ্রি অর্জন করবেন। একইভাবে কেউ
যদি অন্য বিষয়ে অনার্স করে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে চান তাহলে তাকে Common Law Admission Test (CLAT)
ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ৩ বছরের এল এল বি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ৫ বছরের আইনের অনার্স বা ৩ বছরের এল
এল বি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি গ্রেস এডভোকেট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকে এরই মাঝে সে বার কাউন্সিল এর নির্ধারিত
পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। ২ বছরের মধ্যেও যদি কেউ পাশ না করেন তাহলে তার এডভোকেট সনদ হোল্ড হয়ে যায়
এবং AIBE পাস না করা পর্যন্ত তা বহাল থাকে। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি হচ্ছে ১০০ নম্বরের এম সি কিউ। ওপেন বুক এক্সাম।
যার সময় নির্ধারণ করা থাকে ৩ ঘন্টা ৩০ মিনিট এবং পাশ মার্ক ৪০ শতাংশ। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা
অনুযায়ী প্রতি ৬ মাস পর পর নতুন পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় এবং পরীক্ষা গ্রহণের ও রেজিস্ট্রেশনের দিন তারিখ সময় বার
কাউন্সিল ক্যালেন্ডারে উল্লেখ থাকে।
পাকিস্তান-
ভারতের ন্যায় পাকিস্তানেও আইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য বার কাউন্সিল অফ পাকিস্তান থেকে পরিচালিত ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে
আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। এমনকি গ্রাজুয়েশনের পর এল এল বি ডিগ্রির জন্য ও এ ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে
আইনে ভর্তি হতে হয়। পাকিস্তানে কোন পাস্ কোর্স নেই যে কোন এল এল বি ডিগ্রি ৫ বছর পড়াশুনা করেই অর্জন করতে হয়,
এই নিয়মটি ২০০৫ সালে তৈরী করা হয়। গ্রাজুয়েশন/ এ লেভেলে/ পি এস সি তে নূন্যতম ৫০ শতাংশ নম্বর থাকলে একজন
ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় অনশগ্রহন করতে পারেন। এই পরীক্ষাটির নাম LAT- Law Admission Test. আইনে বিষয়ে ৫ বছরের
ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীকে বার কাউন্সিল নির্ধারিত পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয় যার নাম হচ্ছে Law GAT। পরীক্ষাটি
পাকিস্তানের উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
পরীক্ষার নিয়ম হচ্ছে ১০০ নম্বরের এম সি কিউ আকারে রিটেন + ভাইবা। এল এল এম ডিগ্রীধারীদের ও ব্যারিস্টারদের
ভাইবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় না। প্রত্যেকটি পরীক্ষা আলাদা ভাবে আলাদা দিনে ও সময়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পাশ
মার্ক ৪৫ শতাংশ। প্রতি ৭ মাস অন্তর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
শ্রীলংকা-
আইন পাস করার পর কোন পরীক্ষা দিয়ে এডভোকেট হতে হয় না কিন্তু আইনে পড়ার জন্য বার কাউন্সিল থেকে নির্ধারিত
প্রতিবছর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এল এল বি অথবা ব্যাচেলর অফ এটর্নিতে পড়াশুনা করতে হয়। ব্যারিস্টার বা বিদেশি
এল এল বি ডিগ্রিধারীদের বার কাউন্সিল এর নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি ফাইনাল ১ বছর পড়াশুনা করে
পরীক্ষায় পাস করতে হয়। এরপর থেকে তারা কোর্টে প্রাকটিস করতে পারেন।
আফগানিস্তান-
আফগানিস্তানে আইনে ডিগ্রি অর্জন করার পর শুধুমাত্র ট্রেনিং এর মাধ্যমে অ্যাডভোকেট এর সনদ প্রদান করা হয়। ২০০৮
সালে আফগানিস্তানে স্বাধীন বার এসোসিয়েশন গঠন করা হয়। বার এসোসিয়েশন আইনের অনুচ্ছেদঃ ৬ এ বলা হয়েছে বার
এসোসিয়েশন যদি সঠিক মনে করে তাহলে ট্রেনিং এর মাধ্যমে অথবা পরীক্ষার মাধ্যমে সদস্য অন্তর্ভুক্তি করতে পারে। তবে
বর্তমানে ট্রেনিং এর পদ্ধতি চালু আছে যেহেতু সম্প্রতি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ।
মালদ্বীপ-
এখন পর্যন্ত মালদ্বীপে আইনে ডিগ্রি অর্জন করার পর শুধুমাত্র এপ্লিকেশন জমা দেয়ার মাধ্যমে অ্যাডভোকেট এর সনদ প্রদান
করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে মালদ্বীপের নতুন সরকার বার কাউন্সিল এর পরীক্ষা পদ্ধতির প্রণয়ন সংক্রান্ত সুপারিশ
জাতিসংঘে জমা দিয়েছে। অনুমোদনের জন্য এটা পেন্ডিং রয়েছে। যেহেতু এপ্লিকেশনের মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে
থাকে তাই কোন নির্ধারিত সময় নেই।
নেপাল-
১০০ নম্বরের রিটেন+ ভাইভা। রিটেন এবং ভাইভা আলাদা দিনে আলাদা সময়ে হয়ে থাকে। রিটেন পরীক্ষার জন্য সময় ৩
ঘন্টা। প্রতি বছর অন্তত ১ বার পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কিছু বছর ২ বারও পরীক্ষা হয়েছে।
ভুটান-
৫০০ নম্বরের (পার্ট ১- লিগ্যাল ইংলিশ- এম সি কিউ ১০০ মার্ক +রিটেন ১৫০) বিরতি (পার্ট-২ আইন- এম সি কিউ
১০০+রীটেন ১৫০) একই সাথে একই দিনে পরীক্ষা হয়ে থাকে প্রত্যেক পার্ট এ পাশ মার্ক ৫০ শতাংশ। অথবা সম্মিলিত ৬০
শতাংশ। প্রতি বছর অন্তত ১ বার পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কিছু বছর ২ বারও পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষাটি একটি
দিনে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের বিরতি সহ দীর্ঘ ৭ ঘন্টা ৩০ মিনিট ব্যাপী হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ-
১০০ নম্বরের এম সি কিউ+ ১০০ নম্বরের রিটেন+ ৫০ নম্বরের ভাইবা। প্রত্যেকটি পরীক্ষা আলাদা ভাবে আলাদা দিনে ও
সময়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পাশ মার্ক ৫০ শতাংশ। ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা অনুযায়ী গড়ে প্রতি ১ বছর ৬
মাস পর পর নতুন পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এবং এই দীর্ঘসূত্রতা ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা অনুযায়ী
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পরে গড়ে প্রতি ২ বছর ৬ মাস পর নতুন প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধ আক্রান্ত দেশ ছাড়া
যা বিশ্বে বিরল ইতিহাস।
সকল সার্কভুক্ত রাষ্ট্রের এডভোকেট/ এটর্নি তালিকাভুক্তির নিয়ম থেকে দেখা যায় একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন
সার্কভুক্ত রাষ্ট্রের এডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় ৩ স্তর বিশিষ্ট পরীক্ষার অস্তিত্ব নেই। বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই ১ স্তরের বা
সর্বোচ্চ ২ স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি বিদ্যমান। আর এই তিন স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণেই এডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষা
গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে। যার কারণে বিগত ৮ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই অধিক বিলম্বের অসহনীয় যন্ত্রনায় আইন পেশা
ছেড়েও দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের থেকে যে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে তা কোনভাবেই ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এই বিলম্ব
এতটাই অসহনীয় পর্যায় চলে গিয়েছে যে শিক্ষানবিস আইনজীবীরা বাধ্য হয়ে জীবনের মায়া মমতা ত্যাগ করে করোনা
ভাইরাস এর মাঝেও আন্দোলন ও অনশন করছেন। অতি দ্রুত এমনকি প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে হলেও এই সমস্যা
সমাধান করা প্রয়োজন।
Discussion about this post