অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান:
সন্ত্রাস বিরোধী আইনে বাধা নিষেধঃ ২০০৯ সালে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ এবং তাদের কার্যকর শাস্তির বিধানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা হয় যা সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ নামে পরিচিত। এটি ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সংশোধিত হয়। এই আইনের ধারা ৯ এর উপধারা (২) এ বলা আছে, যদি কোন বেক্তি কোন নিষিদ্ধ সংগঠনের সমর্থন চেয়ে অথবা এর কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় করবার উদ্দেশে কোন সভায় বক্তৃতা করেন অথবা রেডিও, টেলিভিশন অথবা কোন মুদ্রণ বা ইলিক্ট্রনিক মাধ্যমে কোন তথ্য সম্প্রচার করেন তা হলে তিনি অপরাধ সংঘটন করবেন। উপধারা (৩) এ বলা আছে কেউ এই ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক সাত বছর ও অন্যূন দুই বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও আরোপ করা যাবে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্ররোচিত (instigation) করবার শাস্তি সম্পর্কে একই আইনের ধারা ১৩ তে বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি তার কর্মকাণ্ড অথবা অংশ গ্রহণের মাধ্যমে কোন দলিল প্রস্তুত বা বিতরণ করেন অথবা কোন মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বা অন্য যে কোন মাধ্যমে তথ্য সম্প্রচার করেন অথবা কোন সরঞ্জাম সহায়তা বা প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনকে এই ধরনের অবগত থেকে সহায়তা প্রদান করেন যে ঐ দলিল, সরঞ্জাম, সহায়তা বা প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহৃত হবে বা ঐ ব্যক্তি বা সংগঠন তাদের অনুরূপ অপরাধ সংগঠনের প্রচেষ্টায় ব্যবহার করবে তা হলে তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্ররোচিত করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তির দুই তৃতীয়াংশ মেয়াদের কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে তাকে দণ্ডিত করা যাবে। যদি ঐ অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয় তা হলে অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বৎসরের কারাদণ্ড হবে কিন্তু তা পাঁচ বৎসরের কম হবে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বাধা নিষেধঃ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ১৪ এর উপধারা (১) এ সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা কোন শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটানো বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা, পতিতাবৃত্তি বা বেআইনী বা নীতিবিগর্হিত কোন কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোন নারীকে বা শিশুকে বিদেশ হইতে আনা বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ অথবা ক্রয় বা বিক্রয় বা কোন নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর, নারী বা শিশুকে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুকে আটক, নারী বা শিশুকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা এবং ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া, যৌন পীড়ন করা, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো বা জখম, ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে শিশুকে অঙ্গহানি ইত্যাদি এমন সব অপরাধের শিকার হয়েছেন এমন নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা এসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্য কোন তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাবে যাতে ঐ নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর এই বিধান লংঘন করা হলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন৷
শিশু আইনে বাধা নিষেধঃ শিশু আইন ১৯৭৪ এর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে কিশোর অপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত বা তাদের পরিচয় সংক্রান্ত কোন তথ্য বা ছবি কোন সংবাদপত্র বা কোন সাময়িকী অথবা কোন সংবাদ সংস্থা প্রকাশ করতে পারবে না। তবে আদালতের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা যাবে যদি তা শিশুটির মঙ্গলের জন্য করা হয়। বিস্তারিত এই বইয়ের ২য় অংশে Children Act 1974 এ উল্লেখ আছে।
পর্নোগ্রাফি আইনে বাধা নিষেধঃ মাঝে মাঝে কিছু টেলিভিশন ,রেডিও, পত্রিকা বা সাময়িকীতে বিনোদনের নামে অশ্লীল নাচ, গানের ছবি, চলচ্চিত্র কিংবা ভিডিও ক্লিপ অহরহ প্রদর্শন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের এগুলো বেশি আকৃষ্ট করে। এতে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মাঝে যেমন নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে তেমন ইভ টিজিং, যৌন হয়রানীসহ আর বিভিন্ন অপরাধের সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দ-বিধিতে অশ্লীলতার কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। তবে ব্রিটেনের সাবেক চিফ জাস্টিস ককবার্ন-এর “হিক্লিন মামলা’র সিদ্ধান্ত অনুসারে, ”যা মানুষের মনকে বিকৃত ও কলুষিত করে সেটাই অশ্লীল।“ মূলত সমাজ ও সমাজস্থ মানুষের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে অশ্লীলতা নিরূপিত হয়। এই ব্যাপারে মিডিয়ার ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১২ প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা এমন কি বহন, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়,ধারণ বা প্রদর্শন করাও গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। পর্নোগ্রাফি বলতে যা বুঝায় তা হল যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। এছাড়াও যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই,পত্রিকা, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কাটুর্ন বা লিফলেটও পর্নোগ্রাফি বলে ধরা হবে। যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদন করে অথবা কোন নারী,পুরুষ বা শিশুকে পর্নোগ্রাফি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে অথবা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে কোন প্রলোভন দেখিয়ে তার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির চিত্র, ভিডিও চিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করে তাহলে তিনি এ ধরণের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ (সাত) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদা হানি করলে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোন সুবিধা আদায় বা কোন ব্যক্তির জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ধারণকৃত কোন পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিকে মানসিক নির্যাতন করলে তিনি এ ধরণের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি এ ধরণের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে গণউপদ্রব সৃষ্টি করলে তিনি সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, ভাড়া, বিতরণ, সরবরাহ, প্রকাশ্যে প্রদর্শন বা যেকোন ভাবে প্রচার করলে অথবা যে কোন উদ্দেশ্যে প্রস্ত্তত, উৎপাদন, পরিবহন বা সংরক্ষণ করলে অথবা কোথায় কোন পর্নোগ্রাফি পাওয়া যাবে এমন স্থান সম্পর্কে কোন প্রকারের বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তিনি সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিতরণ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অথবা শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, সরবরাহ বা প্রদর্শন অথবা কোন শিশু পর্নোগ্রাফি বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তিনি সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫,০০,০০০ (পাঁচ লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে কেউ কোন যুক্তিসঙ্গত কারন ছাড়া এই আইনে কারো বিরদ্ধে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে বা অভিযোগ করলে তিনি সর্বোচ্চ ২(দুই) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কারণ কোন আইনই কাউকে হয়রানি করা হোক তা সমর্থন করে না। এই আইনের অধীন কোন অপরাধ করলে তা আমলযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য।
ভোক্তা অধিকার আইনে বিজ্ঞাপনে বাধা নিষেধঃ আজকাল অনেক টেলিভিশন ,রেডিও, পত্রিকা বা সাময়িকীতে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যা একটি শাস্তিমূলক অপরাধ। ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ এর ৪৩ ধারায় বলা আছে কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশে অসত্য বা মিত্থা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২,০০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাই বিজ্ঞাপন ছাপানোর আগে তা যাচাই বাচাই করে দেখা উচিত। তা হলে মিডিয়া ভোক্তাদের অধিকার সরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করি।
প্রকাশিত সংবাদটি সত্যি আদালত অবমাননার দায়ে পড়ে কিনা সে বিষয়টি নির্ধারণ করার জন্য যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো :
১. সংবাদটি অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে;
২. সংবাদপত্রের উল্লিখিত প্রকাশনাটি বিচারাধীন মামলায় ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টির জন্য;
৩. প্রকাশনাটি বিচারের স্বাভাবিক গতিতে হস্তক্ষেপ অথবা জনমনে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টির উদ্দ্যেশে;
৪. মামলাটি বিচারাধীন বা বিচার আসন্ন এ সম্পর্কে প্রকাশনা কালে পত্রিকাটির পরিপূর্ণ জ্ঞান ছিল কিনা? উপরে উল্লিখিত শর্তগুলো সঠিকভাবে পূরণ করা বা না করার ওপর নির্ভর করে আদালত অবমাননা হবে কি হবে না।
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, কলামিষ্ট,
সভাপতি, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্কাউট, চট্টগ্রাম
Discussion about this post