তানভির চৌধুরীঃ
মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ এই চারটি প্রধান ধর্মসহ পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্মের মানুষ রয়েছে। যে যেই ধর্মের অনুসারী তার উপর সেই ধর্মের আইন প্রয়োগযোগ্য বা প্রযোজ্য। যেমন, মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের উপর মুসলিম আইন প্রয়োগযোগ্য। এক ধর্মের অনুসারীর উপর অন্য ধর্মের আইন প্রয়োগযোগ্য নয়। তাই প্রায় সকল ধর্মের স্বতন্ত্র আইন রয়েছে। মুসলমানদের জন্য মুসলিম আইন, হিন্দুদের জন্য হিন্দু আইন, খ্রিষ্টানদের জন্য খ্রিষ্টান ধর্ম ইত্যাদি। এই আইনগুলো সাধারণত ধর্মীয় গ্রন্থ, রীতিনীতি, কাস্টম ইত্যাদি থেকে চলে এসেছে।
কাদের উপর হিন্দু ধর্ম প্রয়োগযোগ্য বললে সর্বপ্রথমেই বলতে হবে, হিন্দু ধর্ম তাদের উপর প্রয়োগযোগ্য যারা জন্মসূত্রে(মা-বাবার ধর্ম) হিন্দু অথবা অন্য ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। জন্মসূত্র কিংবা ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে প্রায় সকল ধর্মের বিধান প্রায় একই রকম। কিন্তু কিছু সমস্যা হয় বিবাহোত্তর সন্তান বা আমরা যেটা অবৈধ সন্তান হিসেবে জানি সেই সন্তানের ধর্মের ব্যাপারে। কিন্তু, হিন্দু ধর্ম অনেকটা সহজ করেই এই সমস্যাটা সমাধান করে দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে অবৈধ সন্তানের মায়ের ধর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, অবৈধ সন্তানের মা যদি হিন্দু হয় তবে অবৈধ সন্তানটির উপর হিন্দু ধর্মই প্রয়োগযোগ্য হবে। এখন সবচেয়ে মজার কিংবা ব্যতিক্রম বিষয়টি হচ্ছে, আমরা জানি এবং দেখেছি প্রত্যেকটি ধর্মীয় আইন তার স্বীয় ধর্মের অনুসারীদের উপর প্রয়োগযোগ্য, কিন্তু আমাদের দেশের হিন্দু আইনের প্রয়োগ সীমায় কিছু ভিন্নতা রয়েছে। আগেই জানিয়ে রাখা ভালো, ধর্মীয় আইনগুলো ব্যক্তিগত আইন হিসেবে পরিচিত। যেমন, তালাক, দত্তক, দেনমোহর, উত্তরাধিকার ইত্যাদি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়, আর এগুলো সমাধানও করা হয় ব্যক্তিগত আইন তথা ধর্মীয় আইন(অবশ্যই রাষ্ট্র অনুমোদিত) দ্বারা। তাই, যে যেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত তার ব্যক্তিগত আইনি সমস্যাগুলো তার ধর্মীয় আইনের দ্বারা সমাধান করতে হবে। ঠিক সেই হিসেবে, কেবল হিন্দুদের উপরই হিন্দু আইন প্রয়োগ হবে এমনটা স্বাভাবিক হলেও, যেহেতু এই আইনটি পুরোপুরি ধর্মীয় কার্যাবলী বা ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে সেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দু ধর্মের সাথে হিন্দু আইনের পরিধি মানিয়ে চলতে হবে। মূলকথা, যে ধর্মগুলো হিন্দু ধর্মের সাথে সাদৃশ্য অথবা অধীনস্থ, সেই ধর্মগুলো হিন্দু আইনেরও অধীনস্থ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আর্য, শিক, জৈণ, ব্রাহ্মণ, উপজাতি( মণিপুরি, সাঁওতাল, চাকমা) ইত্যাদি। উপরোক্ত ধর্মগুলো হিন্দু ধর্মের সাথে সাদৃশ্য এবং আচার, রীতিনীতি ইত্যাদি সবই প্রায় একই হওয়ায় এদের সকলের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো হিন্দু আইন অনুসারে সমাধান করা হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে কেউ যদি প্রশ্ন করে হিন্দু ব্যতীত কোন কোন ধর্মাবলম্বীদের উপর হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য হবে, তখন উত্তরটা সহজ করে বললে এমন হবে যে, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী এই তিন ধর্মের অনুসারী ছাড়া বাকী সকল ধর্মের অনুসারীদের উপর হিন্দু ধর্ম প্রয়োগযোগ্য। আবার কোন ব্যক্তি যদি হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় এবং পুনরায় হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে তবে তার উপরও হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ভিন্ন ধর্মের দুই জন দুই জনকে ভালবাসে এবং বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়; এখন পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে বা কোন আইনে এই বিয়ে সম্পন্ন হবে? হ্যাঁ, আমাদের দেশে স্পেশাল অ্যাক্ট এর অধীন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে, কিন্তু এখানে শর্ত হচ্ছে প্রত্যেকেই নিজেকে এই আইনের জন্য নিজের ধর্মাবলম্বী নয় বলে ডিক্লার দিতে হবে। যেমন, একজন হিন্দু যদি স্পেশাল অ্যাক্ট এর অধীন ভিন্ন ধর্মের কোন অনুসারীকে বিয়ে করতে যায়, তখন তাকে ডিক্লার দিতে হবে যে, সে এই আইনের অধীন হিন্দু নয়। তবে, অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রে সে হিন্দু, আর সেই কারনেই এই ধরনের ব্যক্তিদের উপরও হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য। মোটামুটিভাবে এরাই হচ্ছে হিন্দু আইনের অধীন যাদের উপর হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য।
একটা বিশাল চার্ট দেখা হল হিন্দু আইনের আওতাভুক্তদের নিয়ে। এখন দেখা যাক কাদের উপর হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য নয়। উপরের আলোচনা থেকে এটা বুঝতে বাকী নেই যে, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদীদের উপর হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য নয়। ঠিক এর সাথে মিল কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী যদি মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়, তার উপরও হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য নয়। তবে, এই তিন ধর্ম অর্থাৎ মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী ছাড়া অন্য কোন ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও তার উপর হিন্দু আইন প্রয়োগযোগ্য, যেহেতু অন্য ধর্মগুলো পূর্ব থেকেই হিন্দু আইনের অধীন। সবশেষে, আবারও সেই অবৈধ সন্তানের ধর্মের বিষয়। যদি অবৈধ সন্তানের মা মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী হয় তবে অবৈধ সন্তানটির উপর হিন্দু ধর্ম প্রয়োগযোগ্য হবে না।
পরিশেষে, একটি আইন সব সময় আপনার সাথে থাকবে আর সেটি হল আপনার ব্যক্তিগত আইন। বাংলাদেশে আপনি যেই ভাবে ব্যবসা করতে পারবেন, আমেরিকাতে সেইভাবে পারবেন না যদি তাদের আইন ভিন্ন হয়। কিন্তু, আপনার ব্যক্তিগত আইন আপনি যখন চাঁদে যাবেন তখনও আপনার উপর প্রয়োগযোগ্য। বলা যেতে পারে, ব্যক্তি স্বয়ং মাইগ্রেট না করলে তার ধর্মীয় আইন তথা ব্যক্তিগত আইন সর্বদা অপরিবর্তনীয়।
Discussion about this post