গত শুক্রবার একটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম । সাধারণত শুক্রবার সব ডাক্তার এই ক্লিনিকে বসার কারণে প্রচন্ড রকম ভীড় ঠেলেও হাসপাতালে ঢোকা কঠিন হয় । কিন্তু গত শুক্রবার তার সম্পূর্ণ উল্টোচিত্র দেখলাম। কোন ভীড় নেই, ডাক্তারের রুমগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, নার্সরাও মোটামুটি অবসরেই সময় কাটাচ্ছে ! খুব অবাক হলাম এই অবস্থা দেখে । হাসপাতালের ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম । ভদ্রলোক আমার বেশ পরিচিত । তাকে জিজ্ঞেস করলাম বলেনতো শুক্রবার হওয়ার পরও কেন এমন খালি খালি লাগছে আজ ! তিনি আমাকে বললেন ভাই এটা মাসের শেষ শুক্রবার । মানুষের হাতে টাকা নেই । তাই হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতেও আসেনি বা কম এসেছে । মাসের শেষ সপ্তাহে ও প্রথম সপ্তাহে কম রোগী আসার একটাই কারণ তা হল এ সময় পকেটে টাকা থাকে না ।
আমি কতক্ষন চুপ করে বসে থেকে তাকে বললাম মানুষের অপারগতা কতটুকু তাইনা ? টাকার জন্য ডাক্তারও মানুষ দেখাতে পারেনা । চাকচিক্যর এই শহরে প্রতিদিন বিলবোর্ডগুলো আপডেট হয়, প্রতিদিনই মুল্য তালিকায় বাড়তে থাকে চাকচিক্যের দাম, স্পা সেন্টারে গিয়ে হারবাল চিকিৎসার নামে লাখ টাকার বিনিময়ে দেহের জৈবিক আনন্দ নিবারণ করে ! এক প্রান্ত আর অপর প্রান্ত যে গরমিল থাকে তার হিসেব কষলে সত্যিই অনেক অমিল তবুও প্রতিদিনের মতই দিন রাত্রির খেলা চলে ।আমরা সেই খেলায় অভ্যস্থ হওয়ার অনুশীলন করে করে ভালো থাকার অভিনয় শিখি । দেয়ালের পাশের অসহায় মুখগুলো যেন আমাদের কাছে তখন অন্য দেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মতই দূরের কোন বঞ্চনা মনে হয় । চলছে এভাবেই । শ্রমজীবি মানুষের কষ্টগুলো অনুভব করার জন্য যারা কাজ করে যায় তারাও যেন এ বিষয়গুলোতে তীব্রভাবে অমনোযোগী ! খাতা কলমে শ্রমকে কেনার জন্য যে আইন আছে শুধু তার নুন্যতম অনুশীলন দেখিয়েই আয় করে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো লক্ষ ক্ষ ডলার !তারচেয়ে বড় লাভবার হচ্ছে আমাদের থেকে যারা কিনে নিয়ে প্রোডাক্ট বিক্রি করছে তারা ! কিন্তু যারা সম্পূর্ণটা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাদের অসুখ বিসুখে ওষুধ কেনার ক্ষমতাও থাকেনা মাস শেষে !
হাসপাতালে আসা এক মায়ের সাথে কথা হল ।তিনি তার শিশুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন। চোখে মুখে উদ্বীগ্নতা দেখলাম । তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাটিকে ডাক্তার দেখিয়েছেন ? তিনি বললেন দেখিয়েছি কিন্তু টেস্ট করাতে পারিনি এবং ওষুধও কিনিনি । বললাম কেন ওষুধ কেনেন নি ? তিনি আমাকে জানালেন বাচ্চার বাবা বেতন পাবেন এক তারিখে এবং বেতন পেয়েই ওষুধ কিনবেন !
আমরা নগর জীবনের মানুষগুলো এত ব্যস্ত যে এই শিশুর কান্না অথবা এই মায়ের শিশুকে নিয়ে রাতের কষ্ট কেউই আমরা অনুভব করতে পারিনা । রাস্তায় একজন প্রতিবন্ধি শিশু শুয়ে ভিক্ষে করছে অথবা হাত পা নেই এমন মানুষ দেখে আমরা যখন হৃদয় থেকে উফ করে উঠি তখনও জানিনা কম বেতন পাওয়া মানুষগুলোর কি কষ্ট ! এই শ্রেণীর মানুষগুলো প্রতি মাসেই কিছু টাকা সীমাবদ্ধতা নিয়ে মাস শেষ করে । হয়ত অসুস্থ কারও দিক বিদিক চিৎকারের শব্দ নিয়েই তাদের কষ্টের রাত পারি দিয়ে আবার সকালে অফিস করতে হয় ! মাস শেষ বলে কথা । ডাক্তার দেখানোর সামর্থ বলে কথা !
আমাদের দেশে পোষাক শ্রমিক যারা রয়েছেন তারাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এমন সমস্যায় পড়ে থাকেন । এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা বীমা ও চিকিৎসা ঋণের ব্যবস্থা বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে । প্রতিটি ইন্ডান্ট্রিতে চিকিৎসা বীমা ও হঠাৎ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ঋণের সুবিধা চালু করা বাধ্যতা মূলক করা যেতে পারে । যদি বীমা এবং ঋণের বিষয়টি চালু করা যায় তবে বড় একটা জনগোষ্ঠি মাসের শেষের টাকা না থাকার কারণে ডাক্তার দেখানো থেকে বঞ্চিত হবে না । সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ যেভাবে আগাচ্ছে তাকে আরও দৃঢ় করতে শ্রমিকের সকল ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এই নিরাপত্তার মধ্যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা অন্যতম ।
যে মা শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন কিন্তু ওষুধ কিনতে পারেন নি সে শিশুর বাবাও একজন পোষাক শ্রমিকই ।শুধু পোষাক শ্রমিকই নয় অন্যান্র ক্ষেত্রে শ্রমিকদের আরও বেশী সমস্যা । যেসব ফ্যাক্টরী সরাসরি বিদেশের সাথে কাজ করে না সেগুলোতে অনিয়ম আরও বেশী ।
সুতরাং শিল্প মন্ত্রনালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয় মিলেই এ ব্যপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন । প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরীতে শ্রমিক চিকিৎসা বীমা ও চিকিৎসা ঋণের ব্যবস্থা করার ব্যপারে আইনকে সঠিকভাবে প্রনয়ন ও আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন । আমি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয় এবং শিল্প মন্ত্রনালয়ের বিনীত দৃষ্টি আকর্ষন করছি এ ব্যপারে ।আশা করি এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন ।
সাঈদ চৌধুরী
সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি
শ্রীপুর, গাজীপুর
Discussion about this post