মৌলিক অধিকার আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আলোচনা করতে হয় মানবাধিকার নিয়ে কারণ সকল মৌলিক অধিকার মানবাধিকার কিন্তু সকল মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয়। মানবাধিকার হচ্ছে Universal, inherent, inalienable, inseparable.
মানবাধিকার শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটো শব্দ হয় মানব এবং অধিকার অর্থাৎ যে অধিকারগুলো ব্যতিত একজন মানুষ, মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারেনা সেগুলোই হল মানবাধিকার। অন্যভাবে বলতে গেলে যে অধিকারের কোন দেশ, জাত, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র হয়না নির্বিশেষে সবাই ভোগ করে। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ও পুরো বিশ্ব সমাজের আর বিভিন্ন দেশ হলো বিশ্বের সমাজের এক একটি অংশ। এ নিয়ে আছে অনেকগুলো Convention যেমন UDHR, ICCPR, ICESCR, DGICCP, DRD এবং আন্তর্জাতিক আইন।
আমরা এখন মৌলিক অধিকারের আলোচনায় আসবো:-
মৌলিক অধিকার বলতে যখন কতিপয় মানবাধিকারকে কোন দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা এবং সাংবিধানিক নিশ্চয়তা (Constitutional Guarantee) দেওয়া হয় তখন সেগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হয়। মৌলিক অধিকার বিষয়টি নাগরিক জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।আমরা মোট জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটা অংশ কেন যেন মনে হয় মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অন্ধকারেই আছি।তাই এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১টি ভাগ রয়েছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধানের প্রস্তাবনা (preamble), প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, মবম -ক ভাগে বর্ণিত সকল অনুচ্ছেদ সমুহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং ১৫০ অনুচ্ছেদসহ এগুলো সংবিধানের মুল ভিত্তি তথা ( Basic Structure) অনুচ্ছেদ ৭খ অনুযায়ী যেগুলো সংশোধনযোগ্য নয়।যেগুলো সংশোধন করলে সংবিধানের মুল ভিত্তি লড়ে যাবে। এর মধ্যেই মৌলিক অধিকারসমুহও রয়েছে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে।
সাংবিধানিক পরিমন্ডলে একে পূজনীয় অংশও বলা চলে যার আভাস পরিলক্ষিত হয় তৃতীয় ভাগের প্রথম অনুচ্ছেদ ২৬, এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচলিত এবং নতুন প্রনয়নকৃত যে কোন আইন যতটুকু অসামঞ্জস্য হবে ঠিক ততটুকুই বাতিল হয়ে যাবে।কারণ সংবিধানকে বলা হয় (Supreme Law of the Land) অর্থাৎ একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। আর মৌলিক অধিকার হলো সর্বোচ্চ আইনের সর্বোচ্চ অধিকার। যা চাইলেই কেড়ে নেওয়া যায়না।
মৌলিক অধিকার সম্পর্কে পাকিস্তান সূপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মুনীর State vs Dosso[11 DLR (SC)1] এই মামলায় বলেছেন “The very essence of fundamental rights is that it is more or less permanent and can not be changed by the ordinary law” বিচারপতি হেদায়েত উল্লাহ I. C. Golak Nath and others (Supreme Court Reporters, May- August, PLD 1967P.867) মামলায় বলেছেন “The declaration of the fundamental rights of the citizens are the inalienable rights of the people… the constitution enables an individual to oppose successfully the Whole community and the state to claim his right”.
আমাদের সংবিধান এ অধিকারগুলোকে শুধু মর্যাদার আসনে আসীন করে ক্ষান্ত হয়নি দিয়েছে এগুলো বলবৎ করণের নিশ্চয়তা। অনুচ্ছেদ ৪৪(১) এই অধিকারসমুহ বলবৎ করিবার জন্য এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের দফা ( ১) অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলেই যে কেউ ১০২ দফা( ১) অনুযায়ী মামলা রুজু করতে পারে। এইবার আসা যাক আমাদের সংবিধান ঘোষিত মৌলিক অধিকারসমুহ কি, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় যে ২৫ টি অধিকার প্রদত্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ১৮টি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এগুলো হলো –
আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান (অনুঃ২৭) ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য না করা(অনুঃ২৮) সরকারি নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা(অনুঃ২৯) বিদেশি খেতাব গ্রহন নিষিদ্ধ করণ(অনুঃ৩০) আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুঃ৩১) জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষন(অনুঃ৩২) গ্রেপ্তার ও আটকের রক্ষাকবচ (অনুঃ৩৩) জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করণ (অনুঃ৩৪) বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ(অনুঃ৩৫) চলাফেরার স্বাধীনতা(অনুঃ৩৬) সমাবেশের স্বাধীনতা(অনুঃ৩৭) সংগঠনের স্বাধীনতা(অনুঃ৩৮) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা (অনুঃ৩৯) পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুঃ৪০) ধর্মীয় স্বাধীনতা (অনুঃ৪১) সম্পত্তির অধিকার (অনুঃ৪২) গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ(অনুঃ৪৩) মৌলিক অধিকার বলবৎ করণ(অনুঃ৪৪) রাষ্ট্রের অবস্থানরত নাগরিক ও বিদেশী উভয়েই ভোগ করতে পারে এরূপ মৌলিক অধিকার ৬টি এগুলো হলো ৩২,৩৩,৩৪,৩৫,৪১ও ৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারসমুহ।শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোগ করতে পারবে ১২ টি এগুলো হলো ২৭,২৮,২৯,৩০,৩১, ৩৬,৩৭,৩৮, ৩৯,৪০, ৪২ এবং ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারসমুহ।
মৌলিক অধিকার বলবৎ করার দুটো পদ্ধতি রয়েছে – (ক)বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial review) (খ)বিচার বিভাগীয় বলবৎ করণ(Judicial enforcement) বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকারসমুহ Highly protected কিন্তু রাষ্ট্রিয় বাস্তবতায় এর সুফল দৃশ্যমান হচ্ছেনা।
প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে কোথাও না কোথাও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকার ও হচ্ছে না।এখানে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে মানুষ কি অধিকার সচেতন নয় নাকি অজানা কোন শঙ্কা থেকে মানুষ কোর্টের মুখোমুখি হচ্ছেনা। আবার আদালতের কার্যক্রমের দীর্ঘসুত্রিতা ও এর বড় কারণ হতে পারে। তাছাড়া এসব প্রতিকার প্রদানে independent of judiciary এবং Cheeks and balance অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন আদালত কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তাও দেখার বিষয়।
Discussion about this post