ফরহাদ আহমেদ তপু: গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বরনকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুরঘটনা ঘটে গেলো যেখানে প্রায় হাজার খানেক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি আসলেই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। জনমনে প্রশ্ন আর কত লাশ পরলে, আর কত মানুষ তার প্রিয়জনদের হারালে এরকম মারাত্মক অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে। দেশের রাঘব বোয়ালদের সীমাহীন নির্লজ্জ দুর্নীতির আর কত মুল্য দিতে হবে এসব খেটে খাওয়া মানুষকে? দেশের আইন কি বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে? দেশে আইনের শাসন থাকলে কি এসব দুর্ঘটনা পরোক্ষভাবে যেটা হত্যাকান্ডের সামিল এড়ানো যেতো না?
যে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়েছে তার মালিক এবং সেখানে অবস্থিত পোশাক কারখানার মালিকদের অতি মুনাফালোভী মানসিকতার কারনে আজ এই মর্মান্তিক লাশের মিছিল। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত করার পরও তারা ভয় ভীতি সৃষ্টি করে শ্রমিকদের সেখানে কাজ করতে বাধ্য করে, যেটা বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১৫০, ১৫১ ও ৩০৪ক অনুসারে গুরুতর অপরাধ।
দন্ডবিধির ধারা ১৫০ মোতাবেক, যে লোক কোন বেআইনি সমাবেশে যোগদানের জন্য বা এর সদস্য হবার জন্য কোন লোক ভাড়া বা নিয়োজিত বা উৎসাহিত করে, বা তার ভাড়া, নিযুক্তি বা নিয়োগে সাহায্য করে, সে লোক এরূপ বেআইনি সমাবেশের সদস্য হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে ও এরূপ ভাড়া, নিযুক্তি বা নিয়োগের অনুসরনে এরূপ লোক দ্বারা যে কোন অপরাধের জন্য সে লোক এই হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে যেন সে এরূপ বেআইনি সমাবেশের অংশগ্রহনকারী ছিল বা সে স্বয়ং এরূপ অপরাধ সংগঠন করেছিল।
এখানে তাকালে দেখা যায় যে, ঘটনার আগেরদিন সেই ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ঘোষনা করা সত্ত্বেও ভবন এবং সেখানে অবস্থিত পোশাক কারখানার মালিকদের বলপ্রয়োগপূর্বক নির্দেশে শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হয়, তাই ধারা ১৫০ এর অধীনে এটি অপরাধ।
দন্ডবিধির ধারা ১৫১ মোতাবেক, যে লোক শান্তিভঙ্গ করার সম্ভাবনাপূর্ণ পাঁচ বা ততোধিক লোকের কোন সমাবেশ ভেঙ্গে দেওয়ার আইনানুগ নির্দেশ দেওয়ার পর জ্ঞাতসারে এরূপ সমাবেশে শরীক হয় বা অবস্থান করে, সে লোক যে কোন বর্ণনার সশ্রম বা বিনাস্রম কারাদন্ডে, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে বা জরিমানা দন্ডে বা উভয় দন্ডে শাস্তিযোগ্য হবে।
ব্যাখ্যাঃ যদি সমাবেশটি ১৪১ ধারার তাৎপর্যাধীন একটি বেআইনি সমাবেশ হয়, তাহলে অপরাধকারী ১৪৫ ধারার আওতায় শাস্তিযোগ্য হবে।
এখানে ভবন ও পোশাক কারখানা মালিকপক্ষ এবং প্রকৌশলী দুর্ঘটনাটি ঘটতে পারে জেনে থাকা সত্ত্বেও এর কার্যক্রম স্থগিত করেনি। তাই ধারা ১৫১ এর অধীনে এটি অপরাধ।
এবং দন্ডবিধি ৩০৪ক মোতাবেক, কোন লোক যদি শাস্তিযোগ্য নরহত্যা বলে পরিগনিত নন এরূপ কোন বেপরোয়া বা অবহেলাজনকভাবে কার্য করে কোন লোকের মৃত্যু ঘটায়, তাহলে সে লোক যে কোন বর্ণনার কারাদন্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা জরিমানা দন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।
এখানে ভবন ও কারখানা মালিকপক্ষের তীব্র অবহেলাজনিত কারনে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে, তাই ধারা ৩০৪ক অনুযায়ী তারা অপরাধী।
এখানে শুধুমাত্র দণ্ডবিধির আওতায় কোন কোন বিধানে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় তা আলোচনা করা হল, এছাড়াও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ এর আওতায়ও দোষীদের বিচার সম্ভব। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল যে উল্লিখিত বিধানে প্রদত্ত শাস্তির পরিমান অপরাধির অপরাধের তুলনায় খুবই নগন্য। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি প্রচলিত, যেটা পর্যন্ত খুব আংশিক পরিমানেই সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই বর্তমানে দেশে বিদ্যমান কঠোরতম আইনগুলোর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অন্যতম, যেটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভুমিকা রেখে চলেছে। সূতরাং অবধারিতভাবেই দণ্ডবিধির মত অপরিহার্য আইনগুলো সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবেই মানুষের মনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভীতির সৃষ্টি হবে। এছাড়াও দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক খাত হিসেবে পোশাক শিল্পের জন্য আলাদা গার্মেন্টস অ্যাক্ট প্রনয়ন ও ট্রাইবুনাল গঠনের সুপারিশ করছি। সর্বোপরি বলতে হয় সাভারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারকে কঠোরভাবে আইনানুগভাবে এ খাতকে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে যেন ভবিষ্যতে আর এমন একটিও দুর্ঘটনা দেখতে না হয়।
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আইন ৪র্থ বর্ষ, চবি।
Discussion about this post