কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধ এখন অতিপরিচিত একটি শব্দ। তাছাড়া কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে কিছু বিকৃত চর্চার কিশোর এবং তাদের কার্যক্রম এতটাই আলোচিত হয় যাতে করে এদের থামানোর ব্যবস্থা না করলেই নয়।
সম্প্রতি গণমাধ্যম টিকটক এবং লাইকি নামের দুইটি এপ্স খুবই আলোচিত হচ্ছে। যেই এপ্সের ইউজাররা ভিডিও করে এডিট করে পরে তা আপ্লোড করে। কিন্তু সেই আপ্লোড আর টিকটক কিংবা লাইকি এর ভিতর সীমাবদ্ধ থাকেনা। তার বিচরণ চলে যায় ফেসবুকের মত বৃহত্তর গণমাধ্যমে। আর সেই ভিডিওগুলোর না আছে কোন মার্জিত স্ক্রীপ্ট না আছে কোন গল্প কিংবা অভিনেতাদের কোন শালীন ভঙ্গী। কয়েক সেকেন্ডের ভিডীও বানিয়ে রাতারাতি বনে যাচ্ছে কথিত সেলিব্রিটি। নিজেদের সংস্কৃতি বর্জন করে তারা টেনে আনছে অন্য দেশের সংস্কৃতি, বাড়ছে অশ্লীলতা এবং ক্ষুন্ন হচ্ছে নিজ দেশের মান।
কিছুদিন আগে এই ভিডিও করা কথিত সেলিব্রেটিদের কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনাও প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ঢাকার গুলিস্তান, ৩০০ ফিট ও উত্তরায় টিকটক এবং লাইকি ভিডিও তৈরি করতে যেয়ে মারামারির মত ঘটনাও ঘটে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার ভিডিওর মাধ্যমে পক্ষ-বিপক্ষ পাল্টা জবাব দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। প্রশ্ন জাগে কারা করছে এসব অপ্রয়োজনীয় ভিডিও? কি তাদের উদ্দেশ্য?
লাইকি/টিকটক সেলিব্রেটিদের মধ্যে ইদানিং সবচেয়ে বেশি নাম আসে “প্রিন্স মামুন” ও “অপু”। বিষয়টি আরও আলোচিত হয় উত্তরার একটি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে, যেখানে টিকটক অপু ভিডীও বানাতে গিয়ে রাস্তা আটকে ওইখানের স্থানীয় বাসিন্দাদের মারপিট করে এবং পরবর্তীতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ও আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। টিকটক অপু তার নিজ দেয়া নাম ” অপু ভাই” নামে পরিচিত। ফেসবুকে আবার অনেকেই তার মুক্তি চেয়ে পোস্ট ও করেছে।
প্রিন্স মামুন কিংবা অপু এদের বয়স দেখলে বুঝা যায় এখনো তাদের ভিতর পূর্ণাঙ্গ ম্যাচিউরিটির অভাব। কিন্তু এদের ভাবভঙ্গী ও বেশভূষায় বস্তির টোকাইদের ও হার মানায়। একটা সময় টোকাই বলতে রেললাইনে পলিথিনের ভেতর আঁঠা ভরে নেশা করা কিশোরদেরকেই হয়ত বুঝাতো। কিন্তু বর্তমানে লাইকি/টিকটক এর বদৌলতে যেন সেসব টোকাইরাই নতুন করে নিজেদের সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছে ডিজিটাল মাধ্যমে। এদের পোশাক থেকে শুরু করে চুলের কাট এমনকি কথাবার্তায় ও পাওয়া যায় সেই টোকাইদের ছাপ। বখাটেপানা আর আত্মঘাতী মনোভাবকেই যেন তারা ধরে নিচ্ছে ভাইরাল হওয়ার মাধ্যম হিসেবে। এমনকি সফলতাও পাচ্ছে অনেকেই। কোন মেধার চর্চা কিংবা প্রতিভা ছাড়াই বিকৃত চর্চার মধ্যে বনে যাচ্ছে একেকজন কথিত ছেলিব্রেটি। কেউ কেউ আবার নামের পরে “ভাই” টাইটেল যুক্ত করে হয়ে যাচ্ছে মস্তান কিংবা বড় ভাই। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এদেরকে আবার অনুসরণ করছে সমাজের কিছু উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে।
এসব টিকটক কিংবা লাইকি এর প্রভাব যে শুধুমাত্র অনলাইনেই বিচরণ করছে তা নয়, বাস্তব সমাজেও পড়ছে এর চিত্র। লাল/টিয়া/নীল তাদের চুলের কালার, পোষাকের ভেতরেও নেই কোন মার্জিত ছাপ উল্টো চেহারা এবং ভাবভঙ্গি যেন তাদের বখাটে/নেশাগ্রস্ত হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেয়, যাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের সমাজের টীনএজরা। এসব এপ্সের যে সকল ভিডিওই নেতিবাচক তেমনটাও নয়,ইতিবাচক ও রয়েছে অনেক ভিডিও কিন্তু আমাদের দেশের যেসব ছেলেমেয়েরাই এই প্লাটফর্ম কে বেছে নিচ্ছে তাদের প্রায় সবাই নেতিবাচক মনোভাব এং কর্মকান্ড এর দ্বারাই আলোচিত এবং সমালোচিত।
কিছুদিন আগে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার হয় “অপু” নামের এক কিশোর। কারণ হিসেবে উত্তরা মডেল থানার ডিউটি অফিসার এসআই মো. ফুয়াদ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,
সড়কে একজনকে মারধরের ঘটনায় অপুর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ।
শুধু তাই নয় টিকটক/লাইকি তে অপুর ফলোয়ার প্রায় ১০ লাখ ছাড়িয়ে। সেই জনপ্রিয় অপু তার একটি ভিডীও তৈরির জন্য উত্তরার একটি রাস্তা ব্লক করে এবং স্থানীয় এক ব্যাক্তি বাঁধা দিলে সেখানে তার কিছু ফ্যান-ফলোয়ার ও তারমতই কিছু বখাটেদের নিয়েই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়। অর্থাৎ সেখানে বখাটে অপুর আধিপত্য বিস্তারেরও কিছু মনোভাব ছিল। তাছাড়া অপুর এই ফ্যান-ফলোয়ার কে কাজে লাগিয়ে তাকে আশ্রয়ের জোগান দেয় উত্তরা কিশোর গ্যাং এর ৩ সদস্য। সংবাদমাধ্যমে জানা যায় পুলিশ তার তদন্ত করছে।
এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে এরা সমাজের একটা বড় যায়গা দখল করে ফেলেছে। ইতোমধ্যে এইসব টিকটক/লাইকি সেলিব্রিটিরা এতটাই মিডিয়া কাভারেজ হয়েছে যে সিনহা হত্যার মত এত বড় একটা রাস্ট্রীয় খবর ওইসব খবরগুলোর জন্য ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। অপুদের মত বখাটে গ্রেপ্তার এতটাই আলোচিত এবং জনপ্রিয় যে সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রায় সব যায়গায় এরাই দখল করে নিয়েছে। এভাবে আগাতে থাকলে হয়ত সমাজের একটা বড় অংশই এদের আওতায় চলে আসবে এবং তখন যেমন ভাবমূর্তি নষ্ট হবে মিডিয়াগুলোর ঠিক তেমনি সামাজিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
একজন কিশোর-কিশোরীর মনে নানাবিধ চিন্তা-ভাবনা আসতে পারে, বয়ঃসন্ধিকালের প্রভাবে এদের মনে অনেক রঙিন স্বপ্ন আসতে পারে। কিন্তু তাদের এইসব রঙিন স্বপ্নগুলি যদি সমাজের নেতিবাচক দিকগুলিকে প্রাধান্য দেয়, তবে সেটা তখন আর শুধু কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেই নয় বরং সামাজিকভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা ইতোমধ্যে অনেকক্ষানি প্রভাব ফেলেছেও। মনোবিজ্ঞানীরাও এসবকে নেতিবাচক বলেই ধারণা করে নিচ্ছে।
১৫ সেকেন্ডের একটা ভিডীওর জন্য দেখা যায় একজন শিক্ষার্থীও নষ্ট করছে ঘন্টার পর ঘন্টা, এসব প্লাটফর্ম থেকে পাচ্ছে সস্তা বিনোদন, বাড়ছে অপসংস্কৃতি, নষ্ট হচ্ছে ভবিষ্যত এবং বাংলাদেশে আশংকা বাড়ছে কিশোর গ্যাং এর মত নানাবিধ অপরাধের সংখ্যা।
তাই এসব অপসংস্কৃতি বন্ধে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং একিসাথে বন্ধ করতে এদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। কারণ একজন সচেতন ব্যাক্তিও যদি এদের নিয়ে মজার ছলে কোন আলোচনা করে কিংবা সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রোল/মিমস বানায় তাহলেও সেসবকে তারা পরিচিতির মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। তাই এদের নিয়ে যতটা সম্ভব সমালোচনা কিংবা আলোচনা না করার অনুরোধ রইল।
বর্তমানের এই ছোটখাট সমস্যাগুলোকে নিয়ে যদি কঠোর আইনি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তবে তা ভবিষ্যতের জন্য আশনি সংকেত। সোস্যাল মিডিয়ার এসব নেতিবাচক প্রভাব যেন বাস্তব জীবনে প্রভাব না ফেলে এবং একিসাথে সোস্যাল মিডিয়াও যাতে সুন্দর পরিবেশের মধ্যে থাকতে পারে এর দায়িত্ব আমাদের সকলেরই নিতে হবে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যেমন যাবেনা একিভাবে কিছু অন্যায় নিয়ে মজার ছলেও অন্যায় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া যাবেনা।
লেখকঃ মুবিন হাসান খান অয়ন
সদস্যঃ Progressive Lawyers Union of Shariatpur [PLUS]
Discussion about this post