ফয়সাল কবির সৌরভ
বর্তমান যুগ হচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। মেধা ও যোগ্যতার বলেই এ যুগে সবাইকে টিকে থাকতে হবে। সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে যারা উত্তির্ণ হতে পারবে তারাই প্রকৃত মেধাবী। যারা যোগ্য ও মেধাবী তারাই জনপ্রশাসনে আসবে। জনপ্রশাসনে মেধাবীরা থাকলে দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়, উন্নয়নের প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারে সাধারণ মানুষ। কিন্তু হায়! এই বাস্তব কথাগুলো আজ মিথ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে জনপ্রশাসনে আসার রাস্তা যোগ্য ও মেধাবীদের জন্য সঙ্কুচিত করে রাখা হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে অমানবিক ও বৈষম্যমূলক।
ছোটকালে বাবা-মা’র কাছে শুয়ে গল্প শুনতাম যদি ফাস্ট হতে পারি তবে এটা দিবে, ওটা দিবে আরও কত কি? এক কথায় মেধাবী হতে হবে। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সরকারী অফিসার হয়ে দেশ ও মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব, পাশাপাশি উজ্জ্বল করব বাবা-মায়ের মুখ। কিন্তু বাস্তবতা হল মেধার বুকে চাবুক মেরে অযোগ্যরা দেশ চালাবে! রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনে মেধাবী ও যোগ্য আমলা নিয়োগের হর্তাকর্তা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন(পিএসসি)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) সহ যে কোন সরকারী চাকরীতে স্থান পাচ্ছেন না মেধাবী ও যোগ্যরা। ৫৬ শতাংশ কোটার ভারে নুয়ে পড়েছে রাষ্ট্র! পৃথিবীতে এমন দেশ হয়তো দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সরকারি চাকরিতে ঢোকার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কোটা ব্যবস্থা। কোটায় পাস, কোটায় ভর্তি, কোটায় চাকরি ইত্যাদি।
যেখানে আমাদের সংবিধান নাগরিকদের জন্য সমতার বাণী শুনিয়ে গেছেন সকল সরকারী ক্ষেত্রে এবং পিএসসি বিশাল এক অসমতার ভাণ্ডার খুলে বসেছেন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়েও! আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, ক্ষমতার পালা বদল হয় সমানুপাতিক হারে কিন্তু নিষ্পেষিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভাগ্য বদলায় না! যেখানে ৩২ তম স্পেশাল বিসিএস এ ৩৩ পেয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়া যায় সেখানে ৩৪ তম বিসিএস এ ৮০+ নম্বর পেয়েও প্রিলিতে পাশ করা যায় না, আবার কোটায় ৫৫ তে পাশ করা যায়! কোটার গণ্ডি সন্তান পেড়িয়ে এখন নাতি-নাতনি পর্যন্ত। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, কী নির্মম পরিহাস!
মুক্তিযোদ্ধারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হল, তাঁদের প্রতি মূল্যায়ন যতখানি না হয়, ততখানি দেখানোর চেষ্টা করা হয় । মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল হতভাগা এ জাতিকে বৈসম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য, কোটা সুবিধা পাবার জন্য নয়। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এ দেশের প্রতিটি ধূলিকণার, একজন স্বশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কখনো অযোক্তিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী কোটা সমর্থন করবেন না। তাঁদের জন্য নিয়োগ লাভের পথ সুগম করা এ জাতির দায়িত্ব, তবে তা ৩০% কোন ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। অন্যান্য কোটাগুলোর ক্ষেত্রেও একইভাবে সংস্কারের কথা ভাবা উচিত। তা না হলে আগামীতে তরুণদের যে বিশাল অংশ বেকারত্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হবে, এ সমাজ তা কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা রাখে কি?
অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, সামরিক বাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাই করতে মেধা ব্যতীত অন্য কোনো কোটা নেই। মেধা এবং শুধু মেধা-ই সেখানে অফিসার পদে নিয়োগ লাভের মাপকাঠি। ক্যাডেট হিসেবে বাছাইয়ের পর কমিশন্ড লাভ করা পর্যন্ত কঠোর দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর পরও বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা নেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। ইংরেজি ভাষার চর্চা এবং তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান তাঁদের করে সমৃদ্ধ। তদুপরি নির্দ্বিধায় বলা চলে, অন্তত মাঝারি স্তর পর্যন্ত তাঁদের পদোন্নতি থাকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। শুধু মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েই তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন। এ কারণেই আজ বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী দক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাদের নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ববোধ করে। সরকারও তাদের কোনো দায়িত্ব দিয়ে আশ্বস্ত থাকে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি হবে বলে। তাহলে রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কেন? সামরিক বাহিনীর মান আরও বৃদ্ধি পাক এ কামনা সবার, তবে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বৃদ্ধির জন্য উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক কোনো প্রত্যাশিত পদক্ষেপ সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কোনোটিই নেয়নি; বরং ক্রমান্বয়ে এগুলো দুর্বল করার পদক্ষেপই লক্ষণীয় হচ্ছে এবং কোটার কুঠারাঘাত ক্রমেই যেন অসহনীয়ভাবে বেড়ে চলছে। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সরকারি কর্মক্ষেএে যে বিশাল মেধা শূন্যতা দেখা দিবে তা হয়ত অনেক কিছুর বিনিময়েও আমরা পূরণ করতে পারবো না।
ইদানিং কোটা সংস্কার আন্দোলন, টেলিভিশন, পত্র পত্রিকা কিংবা ফেসবুক সহ আরও অনেক সামাজিক মাধ্যমে চলছে “কোটা” বিতর্ক । সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক কিছু শিক্ষার্থী, সেই শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে গিয়ে থানায় আটকে রাখা হয় আর ৫০/৬০ জন ছাত্র-ছাত্রিকে! কি বিচিত্র এ দেশ! ভুল কিছু সংস্কার করার কথা বলতে গিয়েও পুলিশের কাছে আটক হতে হয় দেশের সর্বচ্চো বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করা একঝাক তরুনদের! সাথে সাথে জেগে উঠে সারা দেশের শিক্ষার্থী সমাজ। কিছুক্ষণের জন্য অচল হয়ে উঠে রাজধানী সহ সারাদেশ, ফলাফল সকল বন্দীদের মুক্তি। সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে সংস্কার দাবীতে থাকা আন্দোলনকারী সহ শিক্ষার্থীসমাজ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী শাহবাগ থানায় ৬০০/৭০০ জন অজ্ঞাতনামা করে মামলা দায়ের করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ! লক্ষ লক্ষ মেধাবি বেকারের সাথে অনেকটা হাস্যকর কিন্তু নিষ্ঠুর গল্পের অবতারণা করতে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। প্রতিবাদি সভা, মিছিল কিন্তু ইতিহাস কে মনে করিয়ে দেয়, উদ্দীপ্ত তারুণ্য কোনকিছুর বাঁধা ই মানে না কিন্তু। তারুণ্যের জোয়ার থমকে যাবার নয়। অনেকদিন আগে কোটা সংস্কার এর বিষয়ে সামান্য কিছু লেখা-লেখি করেছিলাম। যেখানে আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারক মহোদয় বৃন্দ কোটা কে শুধু কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অনেক ক্ষেত্রে কোটাহীন দের সুযোগ ই বন্ধ করে দিচ্ছেন সেখানে আমার মত ছা-পোষা একজন অভাগার কথা কে শুনবে ? সাম্প্রতিক কালে, NBR, Banglasedh Krishi Bank, ATEO, Agranee Bank, Bangladesh Bank সহ অনেক ক্ষেত্রে কোটার জন্য সার্কুলার হয়েছে, নিয়োগ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কোটাহীন অভাগা রা কোথায় যাবে দয়া করে বলবেন কি জনাবেরা ? মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার রা ছাড়া সকলের অবদান রয়েছে । এ কথা আপনারা মানেন বা নাই বা মানেন, স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী ব্যাক্তিবর্গও বিশ্বাস করতেন। যারা যুদ্ধ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা, যারা বিরোধিতা করেছেন তারা রাজাকার, আর যারা বিরোধিতা করেন নি তারা? আমাদের মোট জনসংখ্যার তুলনায় স্বীকৃতি হীন এ সংখার পাল্লায় সবথেকে ভারী, অথচ আমরা বে মালুম ভুলে গেলাম এ জনসমষ্টির কথা ! এ ক্ষেত্রে আমরা এটাও ভুলে গেছি যে নিরবতা সম্মতির লক্ষণ । আমাদের আইনের ভাষায় যদি বলা যায়, সেখানেও সু স্পষ্ট ভাবে কোন বিষয়ে বিরোধিতা না করলে সেটাকে স্বীকৃতি রুপে মনে করা হয়, তাহলে বৃহৎ এ জনসমষ্টি কি অভাগা ছাড়া আর কিছু ?
ভাবতে কষ্ট লাগে রাজাকার দাদার কোটাধারীরা আজ সরকারী প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয় আর নিরবে কষ্ট সহ্য করা মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করা এক সাধারণ বাবার সন্তান আজ বেকার দিনানিপাত করে ! লাল সবুজের পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আজ নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, কান্না আসে, যা কেউ দেখবার নেই, বুঝবার নেই, আছে শুধু “চাকরি না পাওয়া কুলাঙ্গার” আখ্যা দেবার মত হাজারো মানুষ ।
এবার আসা যাক কেন আমি রাজাকার দাদার কোটাধারী বললাম ? একজন রাজাকার এর ছেলের সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে হয় ১৯৭৮/৭৯ এর দিকে । এই দম্পতির সন্তান-সন্ততি রা আজ নানার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় দেশের প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তা ! ওপার থেকে অট্ট হাসি হাসে সেই রাজাকার, আলবদর… আর আমরা চেয়ে চেয়ে সেই হাসি দেখতে থাকি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম !!
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার-এ সকল নাগরিক কে সমান সুযোগের কথা লেখা থাকলেও টা আজ সেই সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ । আমরা অভাগা, আজীবন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করবার নেই আমাদের… মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি? যদি কোটা প্রথা সংস্কার নাই করেন, তবে সোনালী ব্যাংক কিংবা অন্য কোন সরকারী ব্যাংক কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা পুলিশ বিভাগ কিংবা প্রশাসন… যে কোন একটি খাত কোটাধারী দের জন্য বরাদ্ধ দিয়ে দিন । বৈষম্যের দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেওয়া অভাগারা সেদিকে ভুলেও চোখ তুলে তাকাবে না, সুন্দর স্বপ্নের মৃত্যু হবে, তাও বেঁচে থাকবে বাঁচবার শেষ আশাটুকু… সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করে আমাদের বাঁচবার শেষ ইচ্ছাটুকু কে হত্যা করবেন না……
দৃঢ় কণ্ঠে পরিশেষে মনে করিয়ে দিতে চাই, একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসরমান বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন আবশ্যক, আর তাই মেধা বিকাশের অন্তরায় কোটা পদ্ধতির সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
লেখকঃ আইনজীবী, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ অাদালত।
Discussion about this post