ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত এবং ১ ও ২ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণিত তিনটি অভিযোগের মধ্যে দু’টিতে (৩ ও ৫ নম্বর) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং বাকি একটিতে (৪ নম্বর) আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে।
এর মধ্যে মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালীতে চারজনকে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্মান্তরকরণ এবং দেশান্তরকরণ(৩ নম্বর অভিযোগ) এবং কাকড়াবুনিয়ার আলেয়া বেগমকে গণধর্ষণ ও তার বাবাসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার(৫ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ফোরকান পেয়েছেন ফাঁসির আদেশ। অন্যদিকে সুবিদখালীর শোভা ও সুষমা রাণী নামে দুই হিন্দু নারীকে গণধর্ষণের দায়ে পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ।
প্রমাণিত না হওয়া ১ ও ২ নম্বর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি ও খালাস পেয়েছেন ফোরকান। এ দু’টি অভিযোগ ছিল- সুবিদখালী বাজারের চারজনকে হত্যার পর তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট(১ নম্বর অভিযোগ) এবং সুবিদখালী বাজারের তিন সহোদরকে ধর্মান্তরিতকরণ (২ নম্বর অভিযোগ)।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) সকালে এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম।
মোট মোট ২৯৭ প্যারা সম্বলিত ৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান।
রায়ে বলা হয়েছে, পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামের সাদের মল্লিক ও সোনভান বিবির ছেলে ফোরকান মল্লিক (৬৪) একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগ সদস্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অন্যদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে হত্যার পর তার বাসায় থানা শান্তি কমিটি ও সুবিদখালী পুরাতন হাসপাতাল ভবনে রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প করে মির্জাগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন ফোরকান মল্লিক ও রাজাকার বাহিনী।
হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন ফোরকান মল্লিক। এর মধ্যে ছিল ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(২)(আই) এবং ২০ (২) ধারায় আনা হয় এসব অভিযোগে।
সংক্ষিপ্ত রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, প্রসিকিউশন ফোরকান মল্লিককে রাজাকার কমান্ডার বলে অভিহিত করলেও তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বলে তার অপরাধ দয়া বা করুণা পাওয়ার যোগ্য নয়। ৫ নম্বর অভিযোগে গণধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, গণধর্ষণ হত্যা-গণহত্যার চেয়েও বড় অপরাধ।
সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এ মামলার প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল।
অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফোরকান মল্লিকের ছেলে জহির মল্লিক বলেছেন, আমার বাবা নির্দোষ। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। তবে ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান বলেন, আপিলের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ, আপিল করার সামর্থ্য নেই আসামির।
স্বাধীনতার পরে পলাতক ফোরকান মল্লিক পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশ্যে আসেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন ফোরকান। পঞ্চম শ্রেণি পাস ফোরকান মল্লিক ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবং এলাকায় কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
দুই অভিযোগে ফাঁসি
প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালীতে নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদবাহক কাকড়াবুনিয়া গ্রামের হাফিজ উদ্দিন খলিফা, মির্জাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের জমাদ্দার, সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করেন। গণহত্যা ছাড়াও লুটপাট, ধর্মান্তরকরণ এবং দেশান্তরকরণের মতো অপরাধ করেন তারা।
প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট পটুয়াখালীর কাকড়াবুনিয়ার আলেয়া বেগমকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাবা হাতেম আলী বাধা দিলে ফোরকান মল্লিক তাকে গুলি করে হত্যা করেন। আলেয়া বেগমকে পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে তিনদিন আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হয়। আলেয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সনদ কুমার এবং এলেম উদ্দিনকেও গুলি করে হত্যা করেন ফোরকান মল্লিক।
এক অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ
প্রমাণিত চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট সুবিদখালীর শোভা এবং সুষমা রাণী নামে দুই হিন্দু নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করেন ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগীরা।
প্রমাণিত হয়নি দুই অভিযোগ
প্রমাণিত না হওয়া প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার, তার স্ত্রী বিভা রানী, আব্দুল কাদের জমাদ্দার ও হাফিজ উদ্দিন খলিফাকে গুলি করে হত্যার পর তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট করেন ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগীরা।
প্রমাণিত না হওয়া দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী বাজারের তিন সহোদরকে ধর্মান্তরিত করা হয়। তিন ভাই, রমণী কুণ্ডু, ডা. শ্যামসুন্দর কুণ্ডু ও সুনীল কুণ্ডুকে আটকের পর ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগীরা ধর্মান্তরিত করেন।
সকাল দশটা ৪১ মিনিটে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামের সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। দশটা ৪৪ মিনিটে মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী ফোরকানের মামলার রায় ঘোষণা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান। ১১ মিনিটে দশটা ৫৫ মিনিটে রায় পড়া শেষ হয়।
এর আগে দশটা ৩৬ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয় ফোরকানকে। সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে এনে তাকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বের করে তাকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় মাইক্রোবাসটি। তার পরনে ছিল সাদা রঙের পায়জামা ও নীল রঙের চেক লুঙ্গি। চিন্তাযুক্ত অবস্থায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রায় শোনেন তিনি।
Discussion about this post