অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান:
জাতীয় পতাকার ব্যবহার সম্পর্কিত বিধিমালা (পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ফ্লাগ রুলস্ ১৯৭২) প্রায়ই লঙ্ঘিত হবার অভিযোগ পাওয়া যায়। জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে গিয়ে এর যথাযথ ব্যবহার না করা কিংবা পতাকা ব্যবহারের অনুপযুক্ত ব্যক্তির পতাকা ব্যবহারের ফলে জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা হয়।
এমনকি অতীতে দেখা গেছে মন্ত্রী সভার সদস্যরা পর্যন্ত জাতীয় পতাকা বিধি লঙ্ঘন করেছেন মর্মে সংবাদ পাওয়া গেছে। খোদ মন্ত্রীসভা বিভাগ অবহিত হয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা বিভাগ অফিস সার্কুলার পর্যন্ত জারি করেছিল।
জাতীয় পতাকা বিধির ধারা ৬-এর ২ উপধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পীকার, কেবিনেট মন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তি, ডেপুটি স্পীকার, চীফ হুইপ, সংসদের বিরোধী দলের নেতা, প্রতিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থিত কুটনৈতিক মিশন বা কনস্যূলারের অফিস প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
এবিধি লঙ্ঘিন করে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্যের বাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলিত করা যাবে না। তবে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (সঃ), ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে, সরকার কর্তৃক বিজ্ঞাপিত অন্য যে কোন দিবসে সারা বাংলাদেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারী ভবন সমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কুটনৈতিক মিশন সমূহ ও কনসুলার অফিস সমুহে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করা হবে। তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে (আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে) ও জাতীয় শোক দিবস এবং সরকার ঘোষিত অন্য যে কোন দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
বাংলাদেশের পতাকা সকল কর্ম দিবসে সকল গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন এবং অফিসে, (যথা রাষ্ট্রপতির ভবন, সংসদ ভবন প্রভৃতি), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল মন্ত্রনালয় এবং সচিবালয় ভবন সমূহ, হাইকোর্ট, জেলা ও দায়রা আদালত ভবন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক/ কালেক্টরদের কার্যালয়, উপজেলা/ জেলা পরিষদ কার্যালয়, কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগার সমুহ, থানা, কাস্টম পোস্টসমুহ এবং সরকার সময়ে সময়ে অন্য যে সমস্ত ভবন বিজ্ঞাপিত করবেন সেখানে উত্তোলন করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি তাঁর মটর গাড়ী, নৌযান এবং বিমানে পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন। এছাড়া আরো যে সকল ব্যক্তিগণ তাঁদের মটর গাড়ী ও নৌযানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন তারা হলেন :-
(ক) উপ-রাষ্ট্রপতি; (খ) প্রধানমন্ত্রী; (গ) স্পীকার; (ঘ) কেবিনেট মন্ত্রীগণ, (ঙ) কেবিনেট মন্ত্রী এর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ; (চ) জাতীয় সংদের ডেপুটি স্পীকার; (ছ) চীফ হুইপ; (জ) সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা; (ঝ) বিদেশে অবস্থিত কুটনৈতিক মিশন/ কন্সুলার অফিসের প্রধানগণ, (ঞ) তবে প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ শুধুমাত্র রাজধানীর বাইরে দেশের ভেতরে বা বিদেশে ভ্রমনের ক্ষেত্রে তাঁদের মটরগাড়ী এবং নৌযানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন। রাজধানী অভ্যন্তরে পারবেন না। উপরের ক্ষেত্র সমুহে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিগণ যখন গাড়ীতে বা নৌযানে থাকবেন না তখন তথায় পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।
অতীতে দেখা গেছে জাতীয় পতাকা বিধি লঙ্ঘন করে সরকারের উপমন্ত্রীর ও কতিপয় সচিবের বাসভবনে নিয়মিতভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। নিয়ম না জানার কারণে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাসভবনে পর্যন্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো।
১৯৯৯ সালের ১৮ই জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সম্পর্কে অবহিত হয়ে উক্ত বছর ২৮জুলাই এক অফিস সার্কুলারে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বন্ধ করে দেয়। মন্ত্রিপরিষদের সার্কুলারে বলা হয়েছিল, ‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জাতীয় পতাকা বিধি ১৯৭২- এর ৬ (২) নং বিধি লঙ্ঘন করে কোনো কোনো সরকারি বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে এবং জাতীয় পতাকা বিধি বহির্ভূতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় পতাকা বিধি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় পতাকার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় পতাকার সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা।
সুতরাং জাতীয় পতাকা বিধি সঠিকভাবে পালন করা উচিত।’ সকল সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের একান্ত সচিব বরাবরে বিতরণকৃত এ সার্কুলারে ‘জাতীয় পতাকার যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলকে জাতীয় পতাকা বিধি, ১৯৭২ সঠিকভাবে প্রতিপালনের জন্যে অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
দীর্ঘ দিনের গোলামীর জিঞ্জির ভেংগে বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কামান আর মর্টারের গোলাকে প্রতিহত করে এক সাগর রক্তের স্রোত সাঁতরিয়ে এদেশবাসী উত্তোলন করেছে রক্তের স্মৃতিবাহী এ ন্যায়ের পতাকা। তাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এ দেশের লক্ষ লক্ষ প্রিয়জন হারানো গণমানুষের জন্যে একটি সান্তনা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রত্যেকটি স্বাধীন জাতির পৃথক পৃথক জাতীয় পতাকা রয়েছে। জাতীয় পতাকাগুলো যেমন প্রতিটি দেশ ও জাতির নিজ নিজ সংস্কৃতি, সভ্যতা, আশা – আকাংখার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে আমাদের দেশের পতাকাও আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, আশা, আকাংখা এবং আদর্শকে রুপ দিয়েছে।
যে জাতি জাতীয় পতাকার মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে বেশী জানে সে জাতির পতন অসম্ভব। জাতীয় পতাকার প্রতি অকুন্ঠ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা প্রতিটি নাগরিকের প্রাণের দাবী। এ পতাকার সম্মান রক্ষার্থে এদেশবাসী দেখিয়েছে ত্যাগের এক চরম পরাকাষ্ঠা, এ ত্যাগই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে স্ব-গৌরবে খাঁড়া করেছে।
যুদ্ধের সময় হানাদাররা প্রথমে অধিকৃত অঞ্চলের জাতীয় পতাকাকেই বিলুপ্ত করে স্বীয় জাতীয় পতাকা উড়ায়। এর থেকেই জাতীয় পতাকার গুরুত্ব কতটুকু লক্ষ্যনীয়। তাই জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা একটি সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের অজানা থাকার কোন যৌক্তিকতাই নেই।
কিন্তু র্দুভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা বরং রীতিমত অবজ্ঞা, অবহেলা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করা মানেই হলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা করা। এটা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল।
অত্যন্ত ক্ষোভ ও আক্ষেপের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশের জাতীয় পতাকা গুলোর অধিকাংশই ভুল নিয়মে প্রস্তুত। এটা জাতীয় পতাকার প্রতি উপহাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। কোন বিদেশীকে এদেশে এসে এসব বিচিত্র ও রকমারী জাতীয় পতাকা সমুহ দেখে অবাক হতে হয়। রং বেরং (গাড়ো এবং হালকা রং) এর পতাকা সমুহ দেখে মনে হয় যেন দেশটির মানুষ জাতীয় পতাকার মর্যাদা সম্পর্কে সম্পূর্ন অসচেতন।
শিক্ষিতদের মধ্যেও পতাকা বিধি এবং জাতীয় পতাকার অংকন পদ্ধতি না জানারকারণেই এদেশের জাতীয় পতাকার এত রকমারিত্ব। লাল বৃত্তটিও ইচ্ছামত আকাবাঁকাহয়। অনেক সময় অনেক ছেড়া, পুড়ানো ও রং চটা পতাকাও দৃষ্টির গোচরে আসে।জাতীয় পতাকা অর্ধ নমিত করার নিয়ম না জানায় ইচ্ছামত পতাকা টাংগানো হয়ে থাকে।
এতে যার সম্মানার্থে পতাকা অর্ধ নমিত করা হয়েছে তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়তো বটেই বরং জাতীয় পতাকাও হয় অপমানের নির্মম শিকার।
একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সময় কিংবা নামানোর সময় উপস্থিত দর্শকদেরকে অবশ্যই নিঃশব্দে সোজা দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়।কিন্তু মর্মান্তিক হলেও বাস্তব যে, কোন অনুষ্ঠানে যখন জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় তখন অজ্ঞ দর্শকরা এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে দাঁড়ানো তো দূরের কথা বরঞ্চ হই- হুলুর শুরু করে দেয়। এইভাবে প্রতি পদে পদে জাতীয় পতাকাকে আমরা অমর্যাদা করে চলেছি।
জাতীয় পতাকার রংয়ের ব্যাখ্যাঃ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদের ২নং দফায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হবে সবুজ জমিনের উপর খচিত রক্ত বর্ণের ভরাট বৃত্ত।
জাতীয় পতাকার রং হবে বটল গ্রীন (Bottle Green)। সবুজ রং হবে Procion Brilliant Green H-2RS 50 Parts per 1000. এর মধ্যে একটি লাল বৃত্তের রং হবে Procion Brilliant Orange H-2RS 60 Parts per 1000. সবুজ রং তারুণ্যের উদ্দীপনা ও চির সবুজ গ্রামবাংলার সবুজ পরিবেশের প্রতীক।
আমাদের জাতীয় পতাকায় স্বাধীনতার প্রাণস্পন্দনে যৌবনের নব- উম্মেষ ও কর্মোন্মাদনার চাঞ্চল্যকে এর ব্যবহারে রূপদিতে হলে সবুজ রং এর প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোন রং সার্থকতর ও শোভনতর হতো না। লাল রং ২৫ মার্চের কালো রাত্রের অবসান ঘটিয়ে ছিনিয়ে আনা লাল সূর্যের প্রতীক।
আমাদের জাতীয় পতাকায় সবুজের বুক চিরে উদীয়মান সূর্যের রক্তিম গোলক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বংগজননীর মন মুগ্ধকর রূপটি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে উদীয়মান সূর্যগোলকটি। যা বিশ্বের ঘুমন্ত জাতি গুলোকে এক দিকে যেমনি সচেতন করে তোলার সংকেত বহন করে, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর নিপীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্চিত, শোষিত এবং পরাধীন জাতির প্রাণে নব প্রেরণা ও নবীন উম্মাদনা সৃষ্টি করছে।
স্বাধীনতা মানুষের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়, পবিত্রতম অধিকার হতেও অধিক পবিত্র। যা মানুষের মহার্ঘতম বস্তুর চেয়েও অধিক মূল্যবান। ‘জাতীয় পতাকা’ জাতির নিকট পবিত্র ও মূল্যবান বলে তা যত্রতত্র, যখন তখন, ব্যবহার করা উচিত নহে। সাধারণতঃ বিশেষ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানেই ‘জাতীয় পতাকা’ ব্যবহৃত হয়। সরকারী ভবনে সব সময় জাতীয় পতাকা থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ‘জাতীয় পতাকাকে’ অভিবাদন করার রীতি ও প্রচলিত আছে।
আমাদের জাতীয় পতাকা তৈরীর সঠিক নিয়মঃ
দৈর্ঘ্য = ১০ ইউনিট ও প্রস্থ = ৬ ইউনিট আকারের আয়তাকার (Rectangular)। বৃত্তের ব্যাসার্ধ = দৈর্ঘ্যরে ৫ ভাগের ১ ভাগ। প্রস্থকে ৩ ইউনিটে ভাগ করতে হবে। দৈর্ঘ্যকে বামে ৪১২ ইউনিটে এবং ডানে ৫১২ ইউনিট এ ভাগ করে সরল রেখা ((Horizontal Line) টানলে দৈর্ঘ্য প্রস্থ বিভাজন-কারী রেখাদ্বয়ের মিলন বিন্দুই হবে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু। অর্থাৎ লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ পতাকার দৈর্ঘ্যরে এক পঞ্চমাংশ হবে। বৃত্তের রং হবে লাল বাকী অংশ সবুজ।
পতাকার আকারঃ
(ক) ভবনের জন্য পতাকাঃ (১) ১০’*৬’ (২) ৫’*৩’ (৩) ২.৫’*১.৫’ । পতাকার আকার ভবনের আকার অনুযায়ী হবে এবং সরকার প্রয়োজনবোধে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের পরিমাপ বজায় রেখে প্রস্তুতকৃত বৃহদাকার পতাকা প্রদর্শনের অনুমতি দিতে পারেন।
(খ) গাড়ীর জন্য পতাকাঃ (১) ১৫”*৯” (বড় গাড়ীর জন্য); (২) ১০”*৬” (ছোট ও মাঝারি গাড়ীর জন্য)
(গ) আর্ন্তজাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনের জন্য টেবিল পতাকার আকারঃ ১০”*৬”।
পতাকার মর্যাদা রক্ষাঃ
পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য কিছু (বিধি-৭, জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২) নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমনঃ সবসময়ই পতাকার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। পতাকা কোন অবস্থাতেই কোন যানবাহন, রেল বা নৌকার উপরে, পার্শ্বে বা পেছনে জড়িয়ে রাখা যাবে না। অন্যান্য দেশের পতাকা বা নিশানের সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলে, বাংলাদেশের পতাকার জন্য সম্মানিত স্থানটি বা ‘প্লেস অব অনার’ সংরক্ষিত রাখতে হবে। যদি পতাকা বা নিশানের সংখ্যা দুটি হয় তবে বাংলাদেশের পতাকা ডান পার্শ্বে উত্তোলন হবে। পতাকার সংখ্যা দুয়ের অধিক হলে, বেজোঢ় সংখ্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা কেন্দ্র স্থলে এবং জোড় সংখ্যার ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্থলের ডান পার্শ্বের প্রথম স্থানে উত্তোলন করতে হবে।
অন্য কোন পতাকার সংগে আড়াআড়িভাবে পতাকা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকাটি Crossed flag এর ডান পার্শ্বে থাকবে। অর্থাৎ পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাংলাদেশের পতাকাটি উক্ত দাঁড়ানো ব্যক্তির বামদিকে থাকবে এবং পতাকার দন্ডটি অন্য পতাকার দন্ডের সামনে থাকবে। অন্য কোন পতাকা বা নিশান বাংলাদেশের পতাকার চেয়ে উঁচুতে উত্তোলন করা যাবে না। শোভাযাত্রার কেন্দ্রস্থল অথবা শোভাযাত্রার অগ্রযাত্রা সারির ডান পার্শ্বে পতাকা বহন করতে হবে। শীলড বা পদকে (Escutcheon) বেজোড় সংখ্যা পতাকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্থলে এবং সবচেয়ে উপরে ((Highest Point) এবং জোড় সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে শীলড্ বা পদকের ডান পার্শ্বে (অর্থাৎ পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে দাঁড়ানো ব্যক্তির বাম পার্শ্বে) থাকবে।
অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা সর্ব প্রথমে উত্তোলন করতে হবে এবং সবশেষে নামাতে হবে। পতাকা কবরে নামানো যাবে না এবং মাটিকে স্পর্শ করা যাবে না। পতাকা কোন ব্যক্তি বা জড় বস্তুর সাথে জড়ানো যাবে না। পতাকাকে সর্বদাই উর্ধ্বে রেখে মুক্তভাবে বহন করতে হবে।
উচ্চ মাপের সম্মানিত ব্যক্তির কফিন বা মরদেহ পূর্ন সামরিক মর্যাদায় বা পূর্ন আনুষ্ঠানিকতায় পতাকার আচ্ছাদনে দাফনের অনুমতি প্রদান করা যাবে। যেমনঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কফিন বা মরদেহ। সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া পতাকা কোন ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, বৃত্তি, পেশায় বা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা যাবে না।
পতাকা ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়লে যথাযথ মর্যাদার সাথে বিহীত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে পুড়িয়ে ফেলাই শ্রেয়। পতাকা সতেজ কর্মচঞ্চল দ্রুততার সাথে উত্তোলন ও সাড়ম্বরে নামাতে হবে। পতাকা উত্তোলন ও নামানোর আনুষ্টানিকতার সময় কিংবা পতাকা প্যারেড অতিক্রমের সময় উপস্থিত সকল ব্যক্তি পতাকার দিকে মুখ করে সম্মান প্রদর্শন সূচক ভঙ্গিতে দাঁড়াবেন। আনুষ্টিকতার সাথে হলে জাতীয় সংগীতের তালে তালে পতাকা উত্তোলন করতে হয়।
গাড়ী নৌযান বা বিমান ব্যতীত পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে। তবে সংসদের নৈশ অধিবেশন কিংবা রাষ্ট্রপতি ও কেবিনেট মন্ত্রীদের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানের সময় রাতের বেলায় ও ভবন শীর্ষে পতাকা উত্তোলিত রাখা যাবে। পতাকায় কোন কিছু লেখা বা প্রিন্ট করা যাবে না বা এতে কোন চিহ্ন প্রদান করা যাবে না। জাতীয় পতাকা বিধিমালা অনুসরন না করে এর ব্যবহার করা যাবে না।
একটি স্বাধীন দেশ ও সচেতন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য। যেহেতু আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিক এ ব্যাপারে অজ্ঞ, তাই তাদের এব্যাপারে সর্তক করানোর জন্যে ব্যাপক প্রচার- প্রোপোগন্ডার প্রয়োজন। আমাদের দেশের জাতীয় প্রচার মাধ্যম সমুহে রীতিমত কত রকমারি অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। অথচ জাতীয় জীবনে সচেতনতা আনয়নের ক্ষেত্রে এ গুরুত্বপূর্ন বিষয়টির দিকে কারো নজর নেই।
এ ব্যাপারে লেখকের মতে আমাদের দেশের সমস্ত ভুল নিয়মে প্রস্তুত পতাকা সমুহকে বাজেয়াপ্ত করে সঠিক এবং সুষ্ঠ নিয়মে পতাকা প্রস্তুত করে তা সরকারীভাবে জনগনের কাছে সরবরাহ করা প্রয়োজন। নির্ভুল পতাকা সরবরাহের এ- দায়িত্ব কোন কোন সমাজকল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠান, এন.জি.ও. এবং মানবাধিকার সংগঠন সমুহ কর্তৃকও পালিত হতে পারে। ভুল নিয়মে পতাকা প্রস্তুত করলে শাস্তি কিংবা জরিমানার ব্যবস্থা করলেও এ খাম খেয়ালীপনা দুর হতে পারে। ভুল জাতীয় পতাকা নির্ণয় ও বাজেয়াপ্ত করার জন্যে একটি কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। এব্যাপারে জনগণকে সচেতন করানোর জন্যে ব্যাপক প্রোগ্রাম গ্রহণ করা (ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত) প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে লেখক মনে করেন।
সকল বসত বাড়ী, দোকান পাটে যেন সঠিক জাতীয় পতাকা অবশ্যই থাকে, সে ব্যাপারে সরকারের কড়া নির্দেশ প্রদান করা প্রয়োজন। অনেক সময় বিকৃত, কুচকানো, রং চটা ও অতি পুরানো যে সব পতাকা দৃষ্টির গোচরে আসে সে গুলো উৎখাত করে সঠিক জাতীয় পতাকা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরী। এব্যাপারে প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন শিক্ষিত নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মাত্র বয়স্কাউট্সদেরকেই এ পতাকা অংকনের সঠিক পদ্ধতি শেখানো হয়। লেখক এপ্রেরণা ও অনুভুতি সেখান থেকেই পেয়েছেন।
সবশেষে, স্বাধীন বাংলাদেশবাসীর জাতীয় জীবনে জাতীয় পতাকার মর্যাদা অপরিসীম ও সর্বোচ্চ। এটা আমাদেরকে আত্ম প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত জাতিতে পরিণত করার প্রেরণা যোগায়। এ- পতাকা অর্জনে এত বেশী মূল্য দিতে হয়েছে যে বিশ্বের কোন দেশ বা জাতিকে এত মূল্য দিতে হয়নি, ইতিহাস তার সাক্ষ্য। সুতরাং আমরা অনেক মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং আমাদের হাতে যার গৌরব ও মর্যাদা রক্ষার ভার, আমরা বেঁচে থাকতে সে জাতীয় পতাকার পূর্ণ গৌরব বজিয়ে রাখবোই, রাখবো ইনশাআল্লাহ। এটা দেশ ও জাতির পবিত্র আমানত। আমাদের কঠোর শপথ ও দুর্বার প্রত্যয় গ্রহন করতে হবে যে কোন মূল্যে বা চরম ত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে এমনকি জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা এ আমানতের যথাযোগ্য সংরক্ষন ও মর্যাদা রক্ষা করবো।
লেখক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, কলামিষ্ট,
সভাপতি, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্কাউট, চট্টগ্রাম
Discussion about this post