ব্রিটিশ শাসন আমলে এই উপমহাদেশে, ডাকাতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ-রা ১৭৭২ সালে প্রথম একটি আইন করে এবং তাতে বলা হয়, কেউ যদি ডাকাতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তার শাস্তি তিনটে। প্রথম শাস্তি হল, ঐ ডাকাতের মৃত্যুদন্ড। দ্বিতীয় ঐ ডাকাতের যারা পরিবারের সদস্য থাকবে তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় ভাবে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হবে নিলামে। তারমানে পরিবারের সদস্যরা slave হয়ে যাবে। আর তৃতীয় শাস্তি হল, ঐ ডাকাত যেই গ্রামে বসবাস করে, সেই গ্রামের সবার একটা collective fine হবে, সবাইকে জরিমানা দিতে হবে।
এই শাস্তির ভিতর কতগুলো জিনিস খুব পরিস্কার, তারা এমন কতগুলো নতুন ধারণা নিয়ে আসল যেটা আমাদের এই অঞ্চলে কোনদিন ছিল না। সেটা হল একজন ব্যক্তি ডাকাত হলে তার পরিবারের সদস্যদেরও শাস্তি পেতে হবে এবং গ্রামের প্রত্যেকটা অধিবাসীকে জরিমানা দিতে হবে।
Criminal liability always individual liability. কিন্তুু ব্রিটিশরা বল্লো না এখন থেকে পরিবারের সদস্য এবং গ্রামবাসীরাও দায়ী হবে। ডাকাতি কত মারাত্বক অপরাধ এটা বোঝানোর জন্য তারা ১৮০৮ সালে আরকটা চমৎকার আইন করল এবং তাতে বলা হল court থেকে যদি কখনো proclamation বা হুলিয়া দেওয়া হয় কোন ডাকাতের নামে, যে আপনাকে হাজির হতে হবে ওমুক নিদ্রিষ্ট তারিখের ভিতর এবং কেউ যদি ঐ তারিখে হাজির না হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি অপরাধী এটা প্রমানিত ধরে নেওয়া হবে এবং শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। নিরপরাধ প্রমানের জন্য আর কোন evidence প্রয়োজন নাই সাথে Family member দের enslave করতে হবে এবং villagers দের collective fine-ও দিতে হবে। ব্রিটিশরা এটা বলবার চেষ্টা করল যে এটা একটা Peculiarly Indian Offence এবং কিছু দিন যাবার পরে তারা চিন্তা করল যে এটার আরেকটা hive দেয়া দরকার।
ডাকাতি আসলে অনেক ধরনের হয়। ডাকাতির একটা ধরন পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই আছে সেটা হল High way Robbery এবং আমরা যে সময়ের কথা বলছি ঐ সময়ে High way Robbery ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রীকা সব জায়গাতেই ছিল। High way robbery কে এই অঞ্চলে তারা নতুন নাম দেবার চেষ্টা করল যে এরা হল “থাগ” বা “থাগী”; বল্লো এটাও একটা Peculiarly Indian Offence এবং এটা একটা Religious based Offence. তারা গল্প তৈরি করল যে, কিছু লোক আছে যারা মা কালীর অনুসারী এবং এরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একটা রুমাল হাতে নিয়ে, রাস্তা দিয়ে যখন লোক যায়, ঐ রুমাল দিয়ে শ্বাসরোধ করে লোকদের হত্যা করে এবং তার পর সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। যদিও বিশেষ ভাবে উপস্হাপন করার মত এটা কোন অপরাধ ছিল না কেননা এরকম অপরাধ পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই ছিল কিন্তুু তারা বলবার চেষ্টা করল ইন্ডিয়ায় কিছু লোক আছে যারা নিজেরা অপরাধ করতে না চাইলেও ধর্মীয় কারণে বাধ্য হয়ে অপরাধ করে। তারা এই অপরাধ করে মা কালীকে সন্তুষ্ট করবার জন্য। লোকগুলিকে মেরে তাদের উৎসর্গ করত মন্দিরে গিয়ে মা কালীর উদ্দেশ্যে এবং এই “থাগী” narrative তৈরি করে তারা হাজার হাজার লোককে ফাঁসি দিয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হল যাদের ফাঁসি দিয়েছিল তাদের নাম ঠিকানা জোগাড় করে দেখা যায় তাদের ভিতর প্রায় অর্ধেক ছিল মুসলমান। এখন প্রশ্ন হল তাহলে মুসলমানরাও কি মা কালীর উপাসনা করত? তখন তারা বলবার চেষ্টা করল, এখানে মুসলমানদেরও একটা অংশ আছে যারা মা কালীর উপাসনা করে এবং তারা এই High way Robbery করে মা কালীকে সন্তুষ্ট করবার জন্য। এভাবেই “থাগীর” পুরো গল্পটা তারা তৈরি করেছিল যথেষ্ট চাতুরতার মাধ্যমে এবং এই “ডাকাতি” ও “থাগীর” মাধ্যমে তারা তাদের দুটো উদ্দেশ্য সাধন করেছিল। একটি হল তারা দেখাতে চেষ্টা করেছে যে আমরা অসভ্য এবং এখানে এমন কিছু অপরাধ আছে যেটা পৃথিবীর কোথাও হয় না কিন্তুুু বাস্তব সত্যি হল অপরাধ গুলো পৃথিবীর সব জায়গাতেই ছিল আর দ্বিতীয়ত এই fear factor কাজে লাগিয়ে তারা তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ করে নিল। এভাবেই এই বাংলায় ব্রিটিশ-রা দু’শ বছরের শাসন কায়েম করেছিল।
লেখকঃ মোঃ হাবিবুর রহমান বাপ্পী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
Discussion about this post