এড.মোঃ হাবিবুল হক
দাম্পত্যজীবন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সুতরাং দাম্পত্যজীবনের সূচনাপর্ব ‘শুভবিবাহ’ সুন্নত অনুযায়ী ও শরিয়াহসম্মতভাবে সম্পাদন হওয়াই বাঞ্ছনীয়।দাম্পত্যজীবনের প্রবেশের লক্ষ্যে নর-নারীর যুগলবন্দি হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাংলায় ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলা হয় ইসলামে দেনমোহর নারীর অধিকার, যা অবশ্যই স্ত্রীকে প্রদান করতে হবে।মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
বর্তমান সময়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে কার চেয়ে বেশি দেনমোহর দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে- এ নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কনেপক্ষ। বরের সামর্থ্য বিবেচনা না করে বরের ওপর অযৌক্তিকভাবে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না।
উভয় পক্ষের অভিভাবকরা দেনমোহর নির্ধারণকালে একবারও চিন্তা করেন না, বরের বর্তমান আয় অনুসারে মোটা অঙ্কের মোহর আদায়ের সাধ্য তার আছে কি না। এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করারও প্রয়োজন বোধ করেন না।
অনেকেই মনে করেন, দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দিতে হয় শুধু বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে। এটা অজ্ঞতা ও চরম ভুল ধারণা। বিয়েবিচ্ছেদ না হলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা ফরজ।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের মজলিসে পাত্রীপক্ষের চাপে পাত্রপক্ষ দেনমোহরের ক্ষেত্রে সম্মত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যদি কোনো কারণে তালাক হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষকে দেনমোহরের পুরোটাই পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে দেনমোহর ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি তালাক যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকেও দেয়া হয়; তাহলেও দেনমোহর পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য।
ইদানীং অভিযোগ উঠেছে, একশ্রেণির নারী বিয়ের দেনমোহরকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। বিয়ের কিছুদিন পর পরকীয়া কিংবা তুচ্ছ অজুহাতে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এতে করে দেনমোহরের পুরো টাকা বরকে বহন করতে হয়। ইতঃপূর্বে রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে ব্যানারে লেখা ছিল- ‘মেয়ে যদি তালাক দেয়, ছেলেকে কেন দেনমোহর দিতে হবে।’ যত বিপদ ছেলেপক্ষের। অনেক সময় সমাজপতিদের চাপের মুখে ছেলেপক্ষ অতি উচ্চমূল্যে দেনমোহর নির্ধারণ করলেও তার পরিণতি ভোগ করতে হয় নতুন বউকে।
কারণ এ দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে যে কলহের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবনের ওপরে পড়ে থাকে। মনে রাখা উচিত, নবীজি (সা.) তার স্ত্রী, কন্যাদের ক্ষেত্রে কত অল্প অঙ্ক নির্ধারণ করেছিলেন। কাজেই কম মোহরানা নির্ধারণ কোনো সম্মানহানির বিষয় নয়। আবার মোটা অঙ্ক নির্ধারণও কোনো গর্বের বিষয় নয়।
এ কথা বলেও পাত্রপক্ষকে প্রবোধ দেয়া হয়- এসব দেনমোহর তো শুধু কাগজে-কলমে; বাস্তবে কি আর এসব দেয়া লাগে? অথচ ইসলামের বিধান অনুসারে দেনমোহর সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করে দেয়া উচিত।
আবার পাত্রপক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে করেন, যেহেতু দেনমোহরের টাকা দিতে হবে না, সেহেতু নিকাহনামায় কী লেখা আছে বা কী পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ হল; তাতে আমাদের কী এসে যায়? এ চিন্তা গলার কাঁটা হতে পারে; যদি বিবাহটি তালাকের দিকে গড়ায় কিংবা মেয়ে পক্ষের কোনো কুটিলতা থাকে।
অনেক সময় দেখা যায়, যখন কোনো স্ত্রীকে তালাক দেয়া হয়, তখন তার গয়নাগাটি রেখে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। যেহেতু নিকাহনামায় লেখা থাকে, উসুল হিসেবে গয়না দিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করা হল, সেহেতু পরবর্তীকালে এটি প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে- স্বর্ণালংকার তার কাছে নেই এবং পুরো স্বর্ণালংকার পাত্রপক্ষ আত্মসাৎ করেছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অমার্জনীয় একটি পাপের কাজ। কারণ স্ত্রীকে প্রদত্ত স্বর্ণালংকারের মালিক স্ত্রী নিজেই; যতই তাকে তালাক প্রদান করা হোক না কেন।
ইসলামি বিধান অনুসারে, কনেপক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সা নেয়া বা দেয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ।
ছেলেপক্ষ যে অর্থ দেয়, তা হল দেনমোহর; আর মেয়েপক্ষ যা দেয়, তা হল যৌতুক। মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম ও যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ।
দেশের আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামী শরিয়তের বিধানমতে, অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়; বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়।
আজকাল অনেক উচ্চশিক্ষিত আধুনিকা কর্মজীবী নারী দেনমোহর গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তারা মনে করছেন, দেনমোহর গ্রহণ করা মানে নিজেদের পুরুষের তুলনায় নিচু স্তরে নামিয়ে আনা।
এটি পুরুষদের কাছ থেকে নেয়া এক ধরনের যৌতুক। যেহেতু বিয়েতে পুরুষদের যৌতুক প্রথার বিলোপ ঘটেছে, সেহেতু একই রকমভাবে তারা দেনমোহর প্রথার বিলোপ চান। ইসলামী আইনে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল নারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। প্রচলিত ও সামাজিক আইনের মারপ্যাঁচ ও সামাজিক চাপে এখন পুরুষ নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই দেনমোহর।
মোঃ হাবিবুল হক
এডভোকেট
জজ কোর্ট, ঢাকা।
মোবাইল নংঃ ০১৮১৩৬১৩৬৭৯
Discussion about this post