এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিরূপণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইনি প্রতিকার দেয়া। আদালত নাগরিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এ কাজ করে না বরং কারো অধিকার হরণ হলে তাকেই আদালতের দ্বারে ধরনা দিতে হয়। কিন্তু আদালতে প্রতিকার পাওয়া একটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। কিন্তু এসব অপরাধকে আবার বিনা বিচারে যেতে দেয়াও ঠিক হবে না। তবে অভিযোগকারীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, থানা-পুলিশ, বিচারক, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চয়ই আইনি সাক্ষ্যের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবেন না। বন্ধুবর পাঠক, এবার আসল কথায় আসি।
দরিদ্র পরিবারের ফুটফটে ৪ বছর বয়সী মেয়ে শান্তা (ছদ্মনাম)। বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। পড়ন্ত বিকেলের এক নিভৃত সন্ধ্যায় মেয়েটি ধর্ষণের স্বীকার হয়। ৩০ বছর বয়সী নরপশু জহিরুল। খেসারি দেওয়ার নাম করে নিকটবর্তী পদ্মার পাড়ে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে বীরদর্পে চলে যায়। এলাকাবাসী মেয়েটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। চিকিৎসার জন্য আনা হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। মেয়েটির দরিদ্র পিতা ২০০০ সালের ২রা এপ্রিল ধর্ষণের অভিযোগে জহিরুলকে আসামী করে কুষ্টিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতরণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহা হলে তিনি কোন নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
ধর্ষিতা নিজে মেডিকেল বোর্ড ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসামি জহিরুল কর্তৃক ধর্ষণের বর্নণা দেয়। মেডিকেল বোর্ড ভিকটিমকে পরীক্ষান্তে ধর্ষণের সব আলামত দেখতে পায়। মেডিকেল বোর্ড ভিকটিমকে পরীক্ষান্তে তার বয়স চার বছর বলে উল্লেখ করে। কিন্তু গ্রামের এক শ্রেণীর টাউট বাটপার আপোষের নামে ধর্ষিতার পিতাকে ম্যানেজ করে। এ ধরনের আপসের পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, দলীয় চাপ, সন্ত্রাসীদের হুমকি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মাটিতে কোনো শক্ত জিনিসের ওপর পড়ে গিয়ে, গাছে উঠতে গিয়ে, আখখেতের কাটা আখের ওপর পড়ে বা বাঁশঝাড়ের মোথার ওপর পড়ে গিয়ে তাঁর গোপনাঙ্গে আঘাত পেয়েছে মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়, যা বাস্তবতার পরিপন্থী। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি আসামিকে চেনেন না বা আসামি তাঁকে ধর্ষণ করেননি মর্মে আপসের কারণে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ফলে ভিকটিম, বাদীসহ অন্য সাক্ষীরা ভিকটিম ধর্ষিত হয়েছে মর্মে সাক্ষ্য না দেওয়ায় ওই মামলার আসামি জহিরুলকে বিচারক দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিতে পারিনি।
আমাদের দেশে এরকম হাজারও মামলা আপসযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অহরহ বাদীর মামলাকে সমর্থন করে সাক্ষ্য না দেয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর পেছনে যুক্তি দেখানো হয় বাদী-বিবাদী একই সমাজে বসবাস করে। সামাজিক শান্তি রক্ষার্থে এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে । ফলে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটনে পুনরায় উৎসাহিত হচ্ছে। আইন পেশায় থাকার কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সহ বিবেকবান মানুষদের বলতে শুনেছি, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। তাঁদের মনে রাখতে হবে, বিচারের জন্য থানা-আদালতে আসতে হবে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য বিচারালয়ে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে। অন্যথায় মীমাংসা নামের বিচার প্রহসনে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদবে’। থানা-পুলিশ, বিচারক, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চয়ই আইনি সাক্ষ্যের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবেন না। যত দিন পর্যন্ত বিচারপ্রার্থী বিচারের জন্য না কাঁদবেন, তত দিন পর্যন্ত ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদতে থাকবে’।
আরেকটি কেস ষ্টাডিতে জানা যায়, ঘটনার তারিখ ২৭ আগস্ট, ২০০৯। ওই মামলার ঘটনায় ভিকটিম ময়না খাতুন (১৬) (ছদ্মনাম)। তার আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় বর্তমান বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। তিনি থানায় অভিযোগ করেন যে প্রতিবেশী আসামি হান্নান তার সঙ্গে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপর প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। অন্যদের অনুপস্থিতিতে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বেশ কয়েকবার যৌনকর্মে মিলিত হয়। যার ফলে ভিকটিম ময়না খাতুন গর্ভবতী হয়। গর্ভবতী হওয়ার পাঁচ মাস পর ভিকটিম তার মাকে জানায় এবং এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদে একটি সালিসও হয়। আসামি হান্নান ভিকটিম ময়না খাতুনকে বিয়ে করতে অস্বীকার করায় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আসামিকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে ‘ কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তা হলে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি থাকলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং যৌনকর্মের সঙ্গীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তবে যে কোনো নারীর সম্মতি যদি ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অথবা প্রতারণামূলকভাবে আদায় করা হয় তা হলে ওই সব ক্ষেত্রে যৌনকর্ম ধর্ষণের নামান্তর এবং যৌনকর্মের সঙ্গীও ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে।
উপরোক্ত কেস ষ্টাডিতে বিচারক বিচার-বিশ্লেষণ করে এ মামলায় আসামি হান্নানকে খালাস দেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘটনার সময় ভিকটিমের বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর ছিল। এর আগে তার দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং আসামির সঙ্গে তার একাধিকবার যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া ভিকটিমের স্পষ্ট সন্মতি ছিল। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাধা না দেয় অথবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
লেখক: সম্পাদক/প্রকাশক সাপ্তাহিক ‘সময়ের দিগন্ত’, মানবাধিকারকর্মী, গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮, E-mail: seraj.pramanik@gmail.com
Discussion about this post