ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ঘাটতির কারণে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। বেড়েছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ অপহরণের ঘটনাও। লোকলজ্জার ভয়ে যেগুলোর অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে যায় বা খবরে আসে না। এসব নির্যাতিতদের আইনি সুবিধা প্রদান করার লক্ষ্যে ২০০০ সালে তৈরি হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে এটি সংশোধিত হয়।
এ আইনের অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্যে ২৬ ধারানুযায়ী জেলা ও দায়রা / অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজদের মধ্য থেকে ১ জন বিচারককে নিয়ে প্রত্যেক জেলায় এক/একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ১০১ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
★বিচারযোগ্য অপরাধসমূহঃ-
যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌন নিপীড়ন, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানি প্রভৃতি।
যেখানে যৌতুক বলতে ২(ঞ) অনুযায়ী বর পক্ষ/কনে পক্ষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যে কেউ বিবাহ স্থির রাখার শর্তে/পণ হিসেবে আদায়ের লক্ষ্যে অর্থ/সম্পদ/অন্যবিধ কিছু গ্রহণ করাকে বুঝায়।। অপহরণ বলতে ২(খ) অনুযায়ী বলপ্রয়োগ/ভীতিপ্রদর্শন/প্রলুব্ধ/ভুল বুঝিয়ে কাউকে এক স্থান হতে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়াকে বুঝায়।। এবং ধর্ষণ বলতে ২(ঙ)তে দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় বর্ণিত সংজ্ঞা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এই আইনে শিশুর বয়স অনধিক ১৬ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।
★নারী ও শিশু নির্যাতনের শাস্তিঃ-
এ আইনের মাধ্যমে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সংঘটিত কয়েকটি অপরাধ চিহ্নিত করে তার দ্রুত বিচার ও শাস্তি বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে।
ধারা ৪(১) অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি দহনকারী (দহনকারী পদার্থের মধ্যে এসিডও অন্তর্ভুক্ত), ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত কোনো পদার্থ দ্বারা কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটানোর বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করার ক্ষেত্রে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন এবং সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়। এছাড়া যদি কেউ এসব পদার্থের দ্বারা আহত হন বা এসব পদার্থ কাউকে নিক্ষেপের চেস্টা করা হয়, তবে সেক্ষেত্রেও ধারা ৪ অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে।
৭ ধারানুযায়ী অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করার ক্ষেত্রে, যাবজ্জীবন বা চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।। এবং ৮ ধারায় মুক্তি পণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করলে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ধারা ৯ এ নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করার শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান উল্লেখ রয়েছে। এবং দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন এবং সর্বোচ্চ ১ লক্ষ পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এবংকি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কেউ ধর্ষণের শিকার হলে, হেফাজতকারীকে ব্যর্থতার দরুন সর্বোচ্চ ১০ বছর থেকে সর্বনিন্ম ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০০০০ অর্থদণ্ড ভোগ করতে হবে।
ধারা ১০ এ কোনো শিশু বা নারীর উপর যৌন নিপীড়ন করার শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ১০ বছর থেকে সর্বনিম্ন ৩ বছর এবং অর্থদণ্ড রয়েছে। উল্লেখ্য, যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শরীরের যেকোন অঙ্গ/বস্তু দ্বারা কোন নারী/শিশুট যৌন অঙ্গ/অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করাকে যৌন নিপীড়ন বলা হয়।
যৌতুকের (ধারা ১১তে) জন্য মৃত্যু ঘটালে শাস্তি মৃত্যুদন্ড, মৃত্যু ঘটানোর চেস্টা করলে যাবজ্জীবন, গুরুতর আঘাত করলে শাস্তি যাবজ্জীবন/ ১২ বছর থেকে সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম, সাধারণ আঘাত হলে ৩ বছর থেকে সর্বনিম্ন ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করলে তার জন্যও শাস্তির বিধান রয়েছে। শাস্তি (ধারা ১৭) সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম এবং অর্থদন্ড প্রদান করা হবে। ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্য অঙ্গহানির জন্য (ধারা ১২) মৃত্যুদন্ড/যাবজ্জীবন এবং অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।
★থানায় অভিযোগ গ্রহণ না করলে ট্রাইব্যুনালে যেভাবে মামলা দায়ের করতে হয়?
ধারা ২৭ অনুযায়ী কোনো কারণে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) যদি অভিযোগটি গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করেন, তাহলে থানায় কারণ উল্লেখ করে মামলাটি গ্রহণ করা হয়নি মর্মে আবেদনপত্র সঙ্গে নিয়ে সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। এ ক্ষেত্রে মামলাকারী ব্যক্তি প্রথমে নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমনে নিযুক্ত নারী ও শিশু পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি নারী ও শিশু) কাছে প্রত্যয়ন ও সত্যায়িত করে মামলা করতে হবে। এ ছাড়া আবেদনটি বিচারকের সামনে হাজির করার সময় অভিযুক্তকে আদালতে উপস্থিত হয়ে জবানবন্দী দিয়ে মামলা করতে হবে। আদালত অভিযুক্তের জবানবন্দি শোনার পর মামলাটি আমলে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।
★বিচার এবং তদন্ত শেষ করার সময়সীমাঃ
ধারা ২০এ বলা হয়েছে, শুনানি শুরু হলে প্রত্যেক কার্যদিবসে বিচার প্রক্রিয়া টানা চলতে থাকবে। এবং ১৮০ দিনের মধ্যে সেটা শেষ করতে হবে। শেষ না করতে পারলে (ধারা ৩১ক অনুযায়ী) সরকার এবং সুপ্রিমকোর্টকে রিপোর্ট দিতে হবে।
আর তদন্তের ক্ষেত্রে, অভিযুক্ত ব্যক্তি হাতেনাতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করবে। আর অপরাধী ধরা না পড়লে তদন্তের নির্দেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত না হলে তার কারণ ব্যাখ্যা করে সময় শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে জানাতে হবে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছে করলে অন্য কর্মকর্তার ওপর তদন্তভার অর্পণের আদেশ দিতে পারেন। এই আদেশ দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে।
★প্রতিকারের জন্য যাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারেঃ
আপনি যদি মামলা করতে অসমর্থ হন বা কোনো হুমকির সম্মুখীন হন, সেক্ষেত্রে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সহযোগিতা নিতে পারেন। তারা সরকারি খরচে আইন সহায়তা প্রদান করে থাকে। তাছাড়া কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে যারা আপনাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল প্রভৃতি।
Discussion about this post