গত ২৪ জুলাই ১৯৯৮ তারিখে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ডিএমপির ডিবি পুলিশ আটক করে। এরপর তার আত্মীয়স্বজন তার আটকের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য প্রথমে রমনা থানা এবং পরে ডিবি অফিসে যোগাযোগ করলে উভয় অফিসই তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে। ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন রুবেলকে অমানবিক নির্যাতন করার ফলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তার মৃতদেহ ডিবির মিন্টো রোডস্থ কার্যালয়ের পানির ট্যাঙ্কের মধ্যে গুম করা হয়।
হৃদয়বিদারক এ সংবাদ জানাজানি হলে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলে তদানীন্তন সরকার বাধ্য হয়ে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে বাধ্য হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় গত ২০০৩ সালে এসি আকরামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জড়িত অন্যান্য ১৩ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘পুলিশের গ্রেফতার এবং ম্যাজিস্ট্রেটের রিমান্ড প্রদান’ বিষয়ক একটি নির্দেশনা জারি করে।
যা গত ২৪ মে ২০১৬ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ, যার অপর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন যথাক্রমে- তদানীন্তন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন [বর্তমান প্রধান বিচারপতি]- এ বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া ১৫ দফা নির্দেশনা অনুমোদন করেন।
ঐতিহাসিক সেই নির্দেশনাটিই ৫৫ডিএলআর (২০০৩) ৩৬৩ নামে পরিচিত।
যে দফাগুলো ছিল-
১. ডিটেনশন দেয়ার উদ্দেশ্যে কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না।
২. গ্রেফতারকারী পুলিশ [ইউনিফর্ম বা ডিবি পুলিশ, যাই হোক না কেন], কাউকে গ্রেফতার করার সময় তার নিজের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বাধ্য থাকবে।
৩. জিডি’র পাশাপাশি একটি পৃৃথক রেজিস্টার খাতায় গ্রেফতারের কারণ ও গ্রেফতার করা ব্যক্তির বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৪. গ্রেফতার করা ব্যক্তি যদি গ্রেফতারকালীন সময়ে অসুস্থ থাকেন বা আহত হন, তবে সেই অসুস্থতা বা আহত হওয়ার কারণ সবিস্তার উল্লেখ করে গ্রেফতারকারী পুলিশ কর্মকর্তা তাকে নিকটস্থ হাসপাতাল অথবা সরকারি কোনো ডাক্তারের কাছে হাজির করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ডাক্তারি সনদ নেবেন।
৫. গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে থানায় নেয়ার তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই অনু-৩ বর্ণিত লিপিবদ্ধ করার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
৬. গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে যদি তার নিজ আবাসস্থল বা ব্যবসায় চাকরিস্থল থেকে গ্রেফতার না করে অন্য যেকোনো স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে গ্রেফতারকারী পুলিশ এমন গ্রেফতারের বিষয়টি এক ঘণ্টার মধ্যে হয় ফোনে অথবা কোনো বাহকের মাধ্যমে গ্রেফতার করা ব্যক্তির কাছে আত্মীয়স্বজন কাউকে অবহিত করবেন।
৭. গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং তার নিকটাত্মীয়দের সাথে তার চাহিদানুযায়ী সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে।
৮. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যখন ফৌ: কা: ধারা -৬১ মোতাবেক [গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে] আদালতে প্রেরণ করা হবে তখন যদি ১৬৭ ধারা মোতাবেক পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে, তাহলে সেই আবেদনে পুলিশ ৩৮ নম্বর বিপি ফরমে লিখিত কেস-ডায়েরিতে বিস্তারিত সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে বলবে যে, কেন গত চব্বিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরও গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন।
৯. এ রূপ পুলিশ রিপোর্ট অবলোকনের পর যথার্থতা ও যৌক্তিকতা বিবেচনায় ম্যাজিস্ট্রেট হয় গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে মুক্তি, নতুবা জেলহাজতে পাঠাবেন অথবা রিমান্ড দেবেন।
১০. ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যদি প্রতীয়মান হয়, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ কিংবা যথার্থ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, তহাহলে ফৌ: কা: ধারা -১৯০ (১) অনুযায়ী গ্রেফতারকারী পুলিশের বিরুদ্ধে তিনি দণ্ডবিধি ২২০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন [যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড]।
১১. যদি কোনো ব্যক্তিকে রিমান্ডকালীন জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়, তবে যতদিন স্বচ্ছ কাচের দেয়াল নির্মিত কক্ষ তৈরি না হয়, ততদিন এমন একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে যে কক্ষটির মধ্যকার কথাবার্তা বাইরে থেকে শোনা না গেলেও দূর থেকে তাদের দেখা যায়।
১২. পুলিশ আবেদন সন্তোষজনক বিবেচিত হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট যদি রিমান্ড মঞ্জুর করেনও তার মেয়াদ কোনোক্রমেই তিন দিনের বেশি হবে না।
১৩. রিমান্ড আদেশ দানের আগে ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি এবং তার আইনজীবীর বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে শুনে তা বিবেচনায় নেবেন। এরপরও যদি তিনি রিমান্ড দানের আদেশ দেনও তবে পুলিশ হেফাজতে পুনরায় দেয়ার আগে গ্রেফতার করা ব্যক্তির মেডিক্যাল চেকআপ করে নেয়ার আদেশ দেবেন। অতঃপর সেই মেডিক্যাল রিপোর্ট ম্যাজিস্টেটের কাছে দাখিল করে পুলিশ সেই ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেবেন। রিমান্ডে নেয়ার পর শুধু মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে, অন্য কেউ নয়। এবং রিমান্ডের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ উপস্থিতির পর যদি গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি রিমান্ডকালীন তার ওপর কোনো শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ পেশ করেন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে সেই ডাক্তারের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন, যিনি রিমান্ড দানের আগে তাকে পরীক্ষা করেছিলেন।
এরপর সেই ডাক্তারি রিপোর্টে যদি রিমান্ডকালীন নির্যাতনের কোনো প্রমাণ বা চিহ্নের বিবরণ পাওয়া যায়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বিলম্ব না করে ফৌ: কা: ধারা-১৯০(১) অনুযায়ী গ্রেফতারকারী পুলিশের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩৩০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন [যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড]।
১৪. গ্রেফতার করা অবস্থায় জেলখানায় কিংবা পুলিশ রিমান্ডে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে জেল কর্তৃপক্ষ বা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে তা অবহিত করবেন।
১৫. এরপর সংবাদপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট সেই মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। উল্লিখিত নির্দেশনার পাশাপাশি পিআরবি-২৬৩ (৪) এ নির্দেশনা দেয় যে, প্রতিটি সন্দেহভাজন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সেই সন্দেহের যুক্তিসঙ্গত কারণ, তার উৎস মামলা সংক্রান্ত কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করবেন। শুধু যেসব গোপনীয় তথ্য তিনি কোনো জনপ্রতিনিধির নিকট হতে পাবেন, তা তিনি আলোচ্য কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করবেন না। সে ক্ষেত্রে পৃথক একটি কাগজে সে বিষয়টি উল্লেখ করেন তা সংশ্লিষ্ট আদালত এবং মামলার তদারককারী কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন।
Discussion about this post