মোঃ জাহিদ হোসেন:
গেল বছরগুলোতে গুম ও গুপ্ত হত্যা যে হারে বেড়েছে এমনটা বাংলাদেশর ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। বর্তমানে যে কোন বেক্তির মনে হঠা গুম বা গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থাকাটা স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে অনেক নামী বেক্তিও গুম কিংবা বা গ্রেফাতারের নামে নিরুদ্দেশ হয়েছে। পরবর্তীতে ঐ বেক্তি কোথায় আছে, কিভাবে আছে তার কিছুই আর জানা যায়নি। এমন কি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পরও তারা উক্ত বেক্তির কোন খোঁজ তো দিতে পারেই না আবার তাদের সহযোগিতা নিতে গেলে হতে হয় পদে পদে হয়রানীর শিকার।
এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, মূলত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে ই কোন বেক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর তার আর কোন খোঁজ নেওয়া যায় না। আর সংশ্লিষ্ট থানা বা নিকটবর্তী প্রশাসনের সাহায্য নিতে গেলে তারা এর কোন দায়ভারও স্বীকার করে না। কখনো হয়তো নিরুদ্দেশকৃত বেক্তিতির লাশ পাওয়া যায় কখনো বা তাও মেলে না।
আমদের দেশে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়া কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। অর্থাৎ পুলিশ কিংবা রেব সন্দেহ হলেই যে কোন বেক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতে পারে। যার ফলে এই ধারা তাদেরকে একেবারে স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে মত যাকে তাকে যখন তখন তারা সন্দেহ করতে পারে। এর জন্য তাদের কোন জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। আমরা সাধারণ নাগরিক এই ক্ষেত্রে তাদের কাছে অসহায়। এই যেন স্বাধীন দেশে থেকেও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্ধী আমরা । এই ধারায় পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
উল্লেখ্য বিসসের উন্নত দেশগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেটের ওয়ারেন্ট ছাড়া কোন বেক্তিকে গ্রেফতার করার কোন নিয়ম নেই। তাছাড়া ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার ক্রিমিনাল জুরিস্প্রুড্যান্সও সমর্থন করে না। ৫৪ ধারায় আটক বেক্তি অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে যার প্রমান আমরা কম বেশি দেখেছি। এমন কি পুলিশ হেফাজতে অনেক বন্দীর মৃত্যুর কারণও এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা। এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতার অপবেবহার জনগনের জীবন ও বেক্তি স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে যা আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। আর ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত বেক্তিকে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমান ছাড়াই প্রায় সময় চালান করে দেওয়া হয় যা অমানবিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেফতারের এই নিয়ম নিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের দেশে অনেক বার সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। এই ধারা বাতিলের দাবিতে অনেক পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী, শিক্ষক ও সচেতন নাগরিকরা জোর দাবী জানিয়ে আসলেও কোন সরকার এই ধারা বাতিল কিংবা সংশোধন করার উদ্দেগ নেয়নি। সময় সময় মন্ত্রিরা নানা আশার কথা শুনিয়ে গেলেও তারা এই ধারা বিরোধী দলকে দমন ও অপছন্দের বেক্তিদের সায়েস্তা করতে ব্যাবহার করেছে।
যাহোক ফজদারি কারজ বিধির ৫৪ ধারার অধীনে পুলিশের আটক সংক্রান্ত ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ BALST Vs. BANGLADESH (55 DLR 363) মামলায় সরকারকে ৮ টি নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সুপারিশ করে।
কোন বেক্তিকে আটক করার জন্য পুলিশ অফিসার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে তবে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ৩ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করতে পারবে না।
গ্রেফতারের সময় পুলিশ অফিসার পরিচয় প্রদান করবেন এবং যদি প্রয়োজন হয় গ্রেফতারকৃত বেক্তি ও সেখানে উপস্থিত সবাইকে তার পরিচয়পত্র (ID Card) প্রদর্শন করবে।
গ্রেফতারকৃত বেক্তিকে থানায় আনার সাথে সাথে পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করার কারণ নথিভুক্ত করবে এবং আনুষঙ্গিক তথ্য যেমন, আমলযোগ্য অপরাধে ঐ বেক্তির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে তার নিজের জ্ঞান, অপরাধের প্রকৃতি, যে পরিস্থিতিতে তাকে গ্রেফতার করা হলো, তথ্যের উৎস, ঐ তথ্য বিশ্বাস করার কারণ, গ্রেফতারের জায়গার বর্ণনা, গ্রেফতারের তারিখ ও সময় সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ, উক্ত বেক্তির নাম ও ঠিকানা এবং এই উদ্দেশের জন্য থানায় রক্ষিত সাধারণ ডায়েরীতে তা উপস্থাপন করতে হবে।
গ্রেফতারের সময় যদি গ্রেফতারকৃত বেক্তির নিকট কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে, পুলিশ অফিসার তা রেকর্ড করে রাখবেন এবং ঐ বেক্তিকে নিকটস্থ হাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবেন এবং ঐ আঘাতের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করবেন।
গ্রেফতারকৃত বেক্তিকে থানায় চালানের তিন ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রফতারের কারণ জানাতে হবে।
যদি কোন বেক্তিকে তার বাড়ি বা অফিস থেকে গ্রেফতার করা না হয়, তবে তাকে গ্রেফতারের ১ ঘণ্টার মধ্যে তার নিকট কোন আত্মীয়কে টেলিফোন বা বার্তাবাহকের মাধ্যমে জানাতে হবে।
গ্রেফতারকৃত বেক্তিকে তার পছন্দের আইনজীবী বা তার ইচ্ছানুযায়ী কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে দিতে হবে এবং
গ্রেফতারকৃত বেক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করাতে হবে এবং তখন পুলিশ অফিসারকে নির্দিষ্ট আবেদন পত্রে উল্লেখ করতে হবে যে, কেন তদন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়নি, কেন তিনি মনে করেন যে তার অভিযোগের বা তথ্যের সুস্পষ্ট ভিত্তিমূল রয়েছে। এই মামলার প্রাসঙ্গিক তথ্যের অন্তর্ভুক্তির কপি মামালার ডায়েরীর BP from No. 38 একই ম্যাজিস্ট্রেটকে নিকট হস্তান্তর করতে হবে।
কিন্তু যদি এই সকল নির্দেশনা পুলিশ কিংবা রেব সঠিকভাবে মেনে চলত তাহলে সাধারণ নাগরিকদেরকে এতো দুর্ভোগ পোহাতে হত না। মানুষেরও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির উপর অনেক আস্থা থাকত। কেউ পুলিশ ,রেবের পরিচয় দিয়ে আর কোন সাধারণ নাগরিককে গুম বা গ্রেফতারের নামে ধরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত না। আর এই ব্যাপারে আমাদেরকেও সচেতন হতে হবে। আশেপাশের পরিচিত কেউ আজানা কারণে গ্রেফতার হলে দেখতে হবে, কে গ্রেফতার করছে বা তাকে গ্রফতারের নামে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যদি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি হয় তবে অবশই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে থানায় কিংবা আইন অনুমোদিত স্থানে। আর যদি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি না হয়ে থাকে তাহলে তাতে প্রতিরোধ করুন, বাঁধা দিন। তবে আর প্রিয়জনের গুম বা গুপ্ত হত্যার আশঙ্কা থাকবে না।
লেখকঃ সভাপতি, হিউম্যান রাইটস স্টুডেন্ট কাউন্সিল,
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বি.এইচ.আর .এফ), চট্রগ্রাম শাখা
Contact number: 01828 72 79 54
Email: zahidlawcu@gmail.com
Discussion about this post