অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি (ইউএন বেসিক প্রিন্সিপল অন রোল অফ লইয়ার) পেশাগত জীবনে আইনজীবীর প্রাপ্য অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিসমূহের সারসংক্ষেপ ঘোষণা করে। ১৯৯০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কিউবার রাজধানী হাভানায় অনুষ্ঠিত “অপরাধ প্রতিরোধ ও অপরাধীর চিকিৎসা বিষয়ক জাতিসংঘ কংগ্রেস” এর ৮ম অধিবেশনে এই মূলনীতি সর্বোসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
পরবর্তীতে,জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মানবাধিকার বিষয়ক প্রস্তাবে এই মূলনীতিকে স্বাগত জানায়,যা ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০ ইং তারিখে সাধারণ পরিষদের প্রাথমিক অধিবেশন ও তৃতীয় কমিটির অধিবেশনে কোন প্রকার ভোটাভুটি ব্যতীত গৃহীত হয়। তবে এখনো আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি সাধারণ পরিষদ থেকে স্পষ্টভাবে অনুমোদিত হয়নি।
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল কোনো প্রকার অনুচিত হস্তক্ষেপ ব্যতীত আইনজীবীদের কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে আইনের শাসন,মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের সঠিক ভূমিকা প্রসারে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা। আরো সুনির্দিষ্টভাবে, সকল ব্যক্তির সহজ ও কার্যকর আইনী পরিসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ইহার উদ্দেশ্য।
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি শুধুমাত্র আইনজীবীদের নয়,বরং অন্যান্য ব্যক্তি ও সংস্থা যথা বিচারক,সরকারী কৌশলী,নির্বাহী ও আইনসভার সদস্য এবং সাধারণ জনগণের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য গৃহীত হয়।
২৯ টি ধারা বিশিষ্ট এই মূলনীতি পেশাগত দায়িত্ব পালনে একজন আইনজীবীর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অধিকার ঘোষনা করেনি,রাষ্ট্রের প্রতি বাধ্যবাধকতাও ঘোষনা করে। তাছাড়া,এই মূলনীতির প্রয়োগ শুধুমাত্র পেশাজীবী আইনজীবীর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়,পেশাজীবী আইনজীবী ছাড়াও যারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন আইনজীবীর পরিপূরক হিসেবে কার্য সম্পন্ন করে তাদের ক্ষেত্রেও ইহা প্রযোজ্য।
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি ১৬ থেকে ২২ ধারা একজন আইনজীবীর পেশাগত কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অধিকার ও রাষ্ট্রের প্রতি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে:
সকল প্রকার ভয়ভীতি, প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি বা অনুচিত হস্তক্ষেপ মুক্ত পরিবেশে একজন আইনজীবী যেন তার পেশাগত কার্যক্রম সম্পাদনে সক্ষম হয় রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে (ধারা:১৬-এ);
পেশাগত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একজন আইনজীবী মক্কেলের সাথে দেশের ভিতর এবং বাইরে যেন মুক্তভাবে ভ্রমন ও পরামর্শ করতে সক্ষম হয় রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে (ধারা:১৬-বি);
পেশাগত মর্যাদা ও নৈতিকতার অধীনে দায়িত্ব বা কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য একজন আইনজীবী যেন কোন প্রকার দুর্গতি অথবা বিচারিক বা প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোন নিষেধাজ্ঞা অথবা হুমকির সম্মুখীন না হয় রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে (ধারা:১৬-সি);
পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে কোন কার্যক্রম সম্পাদনের ফলে যদি একজন আইনজীবীর নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয় তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে (ধারা:১৭);
পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে একজন আইনজীবীকে তার মক্কেলের পরিচয়ে সনাক্ত করা যাবে না (ধারা:১৮);
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সহ এই মূলনীতির আলোকে দেশীয় আইন ও অনুশীলন দ্বারা অযোগ্য ঘোষিত না হলে কোন আদালত বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ মক্কেলের দ্বারা স্বীকৃত কোন আইনজীবীকে তার পক্ষে আদালতে উপস্থিত হয়ে মামলা পরিচালনার অধিকার বাঁধাগ্রস্থ বা আস্বীকার করবে না (ধারা:১৯);
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একজন আইনজীবীর কোন আদালত,ট্রাইব্যুনাল অথবা অন্য কোন আইনগত বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নিকট সরল বিশ্বাসে প্রাসঙ্গিক মৌখিক বা লিখিত বক্তব্য প্রদান অথবা পেশাগত উপস্থাপনার জন্য সকল প্রকার দেওয়ানী ও ফৌজদারী দায়মুক্তি ভোগ করবে (ধারা: ২০);
মক্কেলকে কার্যকর আইনগত সহায়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পেশাগত আয়ত্তাধীন সকল তথ্য, ফাইল এবং নথি রাষ্ট্র যথাসম্ভব দ্রুততার সংগে আইনজীবীকে সরবরাহ নিশ্চিত করবে (ধারা: ২১);এবং
পেশাগত দায়িত্ব সম্পাদনকালে একজন আইনজীবী ও মক্কেলের মধ্য সম্পাদিত সকল প্রকার যোগাযোগ ও পরামর্শ গোপনীয় বলে সরকার অবশ্য গন্য করবে (ধারা: ২২)।
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি ধারা ২৩ সকল আইনজীবীর মত প্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। উক্ত ধারা অনুযায়ী-
অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের ন্যায় একজন আইনজীবীর মত প্রকাশ ও ধারণ,সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও সমাবেশে অংশগ্রহনের স্বাধীনতা রয়েছে;
পেশাগত অবরোধ আরোপ ছাড়াই একজন আইনজীবীর আইন,বিচার প্রশাসন এবং মানবাধিকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ গ্রহনের অধিকার রয়েছে;এবং
শুধুমাত্র আইনগত সংগঠনের সদস্য হওয়ার কারণে অথবা আইনগত কার্যক্রম পরিচালনার কারণে কোন প্রকার অবরোধ আরোপ ছাড়াই একজন আইনজীবীর স্থানীয়,জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা যোগদান এবং তাদের বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহনের অধিকার রয়েছে।
আইনজীবীর ভূমিকা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মূলনীতি একটি সফট ল’ হিসেবে বিবেচিত এবং কেউ আইনগতভাবে মানতে বাধ্য নয়। তবে,এই মূলনীতি সর্বত্র ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও গৃহীত। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও আঞ্চলিক আদালত এই মূলনীতিকে রেফারেন্স হিসেবে প্রায়শ ব্যবহার করে। তাছাড়া,এই মূলনীতি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস,এমনকি আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
সর্বোপরি,এই মূলনীতিতে অন্তর্ভূক্ত অধিকারসমূহ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি; নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর ব্যবহার অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি; অর্থনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি;মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপিয়ান কনভেনশন;মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউএস কনভেনশন এবং মানব ও জনগনের অধিকার সংক্রান্ত আফ্রিকান সনদসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানবাধিকার চুক্তিসমূহে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ফলে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র এসকল অধিকার কোনভাবে অস্বীকার করতে পারে না,বরং এ সকল অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে সকল প্রকার ভয়ভীতি, প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি বা অনুচিত হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশে একজন আইনজীবীর পেশাগত দায়িত্ব সম্পাদনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী,আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব,জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ; ইমেল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com
Discussion about this post