বিডিলনিউজডটকম<>বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রধান যে সঙ্কট তা হলো বিচার বিভাগ। আমাদের ধারণা, বিচার বিভাগের কাজ হচ্ছে বিচার করা। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা করা। যে মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গড়ে উঠে সেই মানুষের বা ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ এমনভাবে কাজ করছে যেন তাদের দায়িত্ব ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন করা।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে মানুষের মর্যাদা বলে কিছু নেই। যদি থাকতো তাহলে রাষ্ট্র কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারতো না। একটি জীব হিসেবে জীবের প্রতি সাধারণ যে আচরণ রাষ্ট্র হিসেবে আমরা মানুষের সাথে সে আচরণ করছি না। আমাদের রাষ্ট্র সে আচরণ করছে না, আর আমরা তা মেনে নিচ্ছি।
তিনি বলেন, ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করা কোনো তথ্য সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় না। তা জেনেও জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। একজন ব্যক্তি যদি কোনো বিচারকের কাছে গিয়ে নিজে কোনো ঘটনার দায় স্বীকার করেন, তারপরও বিচারকের দায়িত্ব সে কথার স্বপক্ষে প্রমাণ দেখা। আর সেখান থেকেও বেনিফিট অব ডাউটটা আসে ব্যক্তির মর্যাদার পক্ষে। ব্যক্তি হিসেবে যিনি আমাকে রক্ষা করার কথা, যিনি আমাকে আশ্রয় দেয়ার কথা নির্বাহী বিভাগ থেকে, তিনি সেটা দিচ্ছেন না। যেমন পঞ্চদশ সংশোধনী। বিচার বিভাগের কাজ হচ্ছে এটা বলা যেন এই আইন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন করছে।
ফরহাদ মজহার আরো বলেন, রাষ্ট্র গঠনের গোড়াতেই মানবাধিকারের বিষয়টিকে মানতে হবে। এটি মেনে নেয়া না হলে প্রতি বছরই মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাবে। আপনারা লক্ষ করেছেন দেশে প্রতি বছরই মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্নবোধ করতে পারি, আমরা বিক্ষোভ করতে পারি। কিন্তু যতক্ষণ একটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু ধারণাটা টিকে থাকবে, তারা যতক্ষণ নাগরিক আকারে স্বীকৃতি না পাবে, রাষ্ট্রে যদি সমানভাবে তাদের মর্যাদা রক্ষিত না হবে, ততক্ষণ এ ধরনের ঘটনা ঘটবে এবং এর জন্য আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দায়ী করতে থাকব।
তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ১৪৪ ধারার অপব্যবহার করছে। কেবল সহিংসতা প্রতিরোধে এর প্রয়োগ হচ্ছে এমন নয়, বরং এর প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধীপক্ষকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষকেরা বিক্ষোভের জন্য আসছেন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়েছে। কিন্তু আমরা এসব নিয়ে কথা বলছি না কারণ, আমাদের মনে ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে আমরা তো এর শিকার হচ্ছি না, আমাদের তো পেটানো হচ্ছে না, আমাদের তো ট্যাং ভেঙে দেয়া হয় না।
তিনি বলেন, গণপিটুনিতে গত কয়েক বছরে মানুষ হত্যার সংখ্যা খুব বেশি। লোককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ধরে একজনকে ছেড়ে দিচ্ছে, আর মানুষ পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে। সত্যিকার অর্থে বিচারবোধ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে, মানুষের জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো অনুভূতি নেই, আমরা হারিয়ে ফেলেছি। একটি সমাজে যখন ক্ষয় শুরু হয় তখন এই ধরনের গণপিটুনি বাড়তে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের অনাস্থা ও প্রশাসনের যে ব্যর্থতা আছে এই হত্যাকাণ্ড তার বহিঃপ্রকাশ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মানুষের মর্যাদা বলে কিছু নেই। যদি থাকে তাহলে রাষ্ট্র কোনোভাবেই ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারে না। নির্যাতন করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা মানুষ মেরে ফেলছে আমরা তা মেনে নিচ্ছি। রাষ্ট্র যতক্ষণ না ব্যক্তির মর্যাদা তার মত নির্বিশেষে, ধর্ম নির্বিশেষে, তার অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে রক্ষা করবে ততক্ষণ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের যে হত্যাকাণ্ড তা ভয়াবহ। বিএসএফ যে কেবল গুলি করে মারছে তা নয়, ফালানীর লাশ তারা কাঁটাতারে ঝুলিয়েও রাখছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে জখম করা হচ্ছে, তাদের বিবস্ত্র করা হচ্ছে, গ্রেনেড মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকছে তারা, ঘর ভাঙছে, ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। এটার কি অর্থ? সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে যখন একটি রাষ্ট্রকে মুরগির খামারের মতো বানিয়ে ফেলা হয়, তখন এর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হয় না। সীমান্ত রক্ষার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই একটি করে বাহিনী আছে। কিন্তু আমরা আমাদের বাহিনীকে ধ্বংস করে ফেলেছি। বিডিআর এসব ঘটনা থেকে আমাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করত। কিন্তু আমরা তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে লাঠি দিয়ে তাদের দারোয়ান বানিয়ে ফেলেছি।
ফরহাদ মজহার বলেন, উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে আমরা পরস্পরের অংশ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। ভারত থেকেই মুজিবনগর সরকার গঠন হয়েছে। তাহলে আমরা কিসের ভিত্তিতে আজ যারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য লড়াই করছে তাদের ধরে ধরে ভারত সরকারের হাতে সমর্পণ করছি। ভারত সরকারের বাহবা পাওয়ার জন্য? ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো করার জন্য? ভারতের সাথে সম্পর্ক অবশ্যই ভালো করতে হবে; কিন্তু নিজেকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
ভারতে আজ ধর্ষণ নিয়ে আন্দোলন চলছে। কিন্তু একটা সময় এসব নিয়ে ভারতে কোনো কথাই বলা হতো না। ‘অরুন্ধতির মতো সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকেরা বলছেন ভালো কথা ভদ্রলোকরা আজ ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু ত্রিপুরায় যখন একজন নারীকে গণধর্ষণ করা হয়, কাশ্মিরে যখন একজন নারীকে গণধর্ষণ করা হয়, যখন মনিপুরে নারীদের ধর্ষণ করা হয় তখন তোমরা ভদ্রলোকরা কোথায় থাকো? মনিপুরের নারীরা বিবস্ত্র হয়ে সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছিল আসো আমাদের ধর্ষণ করো। তখন তোমরা কোথায় ছিলে? তখন কোথায় ছিল তোমাদের মানবাধিকার। তাহলে মানবাধিকার কি কেবল ভদ্রলোকদের জন্য? দিল্লির লোকদের জন্য?’ আমরা বলতে চাই প্রতিটি মানুষের জীবন মর্যাদাসম্পন্ন, প্রতিটি মানুষের অধিকার রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, সে যেই ধর্মেরই হোক না কেন।
সূত্র: নয়া দিগন্ত
Discussion about this post