তৃতীয় লিঙ্গ আধুনিক আইনি পরিভাষায় নতুন সংযুক্তি। বাংলাদেশ সরকার গত ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী কে ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে কিন্তু এর ফলে তাদের অধিকারসমূহ কিভাবে প্রয়োগ হবে এই সম্পর্কিত কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয় নি। উন্নত দেশগুলোসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতিতেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিশেষ আইনি অধিকার দেয়া হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। যদিও বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সকল ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী এবং একইসাথে সমাজ, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, পারিবারিক সকল ক্ষেত্রেই এরা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। অর্থাৎ, আইনী অধিকারের বঞ্চনার সাথে সাথে এদের নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ জনমতেও রয়েছে বৈষম্য যার অধিকাংশই এদের সাথে ঘটে যাওয়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল এবং সাধারণ মানুষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চশিক্ষিত দায়িত্বশীলদের মাঝেও বিদ্যমান ভুল ধারণার ফলাফল।
নাগরিকত্ব আইন ১৯৫১ অনুযায়ী এদেশে জন্ম নেয়া কোন ব্যক্তি যার পিতামাতা বাংলাদেশের নাগরিক অথবা বিশেষ শর্ত স্বাপেক্ষে পিতা অথবা মাতা এদেশের নাগরিক তাহলে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। ফলে সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত যে অধিকারসমূহ রয়েছে সেগুলো অনুযায়ী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা নাগরিকদের জন্য প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রাপ্তির অধিকারী। অর্থাৎ সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের অধিকারসমূহ যেমন চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের এবং বাক-স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ প্রভৃতি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় তারা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে এবং এদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত এমনকি ডাক্তারদের অজ্ঞতার কারণে তারা এই সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত। আবার একইসাথে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিগণ কিভাবে সম্পত্তির বাঁটোয়ারা পাবেন অথবা তাদের উত্তরাধিকারে অর্জনকৃত সম্পত্তি কেমন হবে তা নিয়ে কোন আইনী প্রতিকার নেই।
তবে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়ে এইসকল অনুচ্ছেদ নিরব। যদিও ইংরেজি টেক্সটে ‘sex’ কথাটি উল্লেখ করার ফলে সকল লিঙ্গের মানুষের অন্তর্ভুক্ত হবার কথা থাকলেও সত্যিকার অর্থে ‘sex’ শব্দটির দ্বারা তৃতীয় লিঙ্গকে বোঝানো হয়েছে কি-না এমন কোন নির্দেশনা নেই। অন্যদিকে ২৮(১) অনুচ্ছেদের বাংলা টেক্সটে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’। অর্থাৎ এসকল অনুচ্ছেদ সমূহে ‘sex’ অর্থ ‘নারীপুরুষ’ হিসেবে গৃহীত হয়েছে যা নিঃসন্দেহে অন্যকোন লিঙ্গকে নির্দেশ করে না।
উল্লেখযোগ্য, সংবিধান প্রণয়নকালে, ১৯৭২ সালের দিকে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কোন তৎপরতা ছিল না এবং আমাদের গণপরিষদের কোন আলোচনাতেও স্বাভাবিকভাবেই এবিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। ফলে, বাংলা অনুবাদ নিশ্চিত করে শুধুমাত্র নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণই এই বিধানগুলোর উদ্দেশ্য। একই সাথে বাংলাদেশ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার প্রদান করে এমন কোন আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তির সদস্যও নয় এবং বাংলাদেশে এই বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কিত কোন আইন বা উচ্চতর আদালতের কোন রায়ও নেই যার মাধ্যমে এদের অধিকার বলবৎ করা যায়। ফলাফলস্বরূপ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মৌলিক অধিকার চেয়ে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার অধিকারও সংবিধান অনুযায়ী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
ভিন্ন যৌন পরিচয় সম্পন্ন ব্যক্তিদের মানবাধিকার সম্পর্কিত জাকার্তা মূলনীতিসমূহের ৩ নং মূলনীতি অনুযায়ী, আইনের চোখে প্রত্যেকেরই একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে। বিভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের ব্যক্তি, জীবনের সবক্ষেত্রে আইনি ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার রাখে। প্রতিটি ব্যক্তির নিজ যৌন প্রবৃত্তি ও লিঙ্গ পরিচয় তাদের ব্যক্তিত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং আত্মপরিচয়, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার চিহ্ন। জাকার্তা প্রিন্সিপালের সূচনাতে লৈঙ্গিক পরিচয় বলতে বোঝানো হয়েছে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত লৈঙ্গিক চেতনা যা জন্মগত লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে । দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান এবং নেপাল এই প্রিন্সিপালের স্বাক্ষরকারী দেশ। যদিও বাংলাদেশ এই প্রিন্সিপালের স্বাক্ষরকারী কোন দেশ নয়, তবুও বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় এই মূলনীতিগুলো সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
জাকার্তা মূলনীতিসমূহে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের বিবেচনা করা নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালে ভারতীয় হাইকোর্ট ঘোষণা করে যে, ‘এটি সামাজিক বা ডাক্তারি বিষয় নয় বরং মানবাধিকারের বিষয়, এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের আইনগত স্বীকৃতির জন্য কোন শারীরিক পরীক্ষার প্রয়োজন নেই (ভারতঃ হিজড়া সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় আইন প্রয়োগ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সংবাদ, প্রকাশ ০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫)।
আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণার অভাব এদের আইনী স্বীকৃতির পথে অন্তরায়। বাংলাদেশ সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য ২০১৪-১৫ কর্মসংস্থান কর্মসূচীর অধীন পরিচালিত মেডিক্যাল পরীক্ষায় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, দারোয়ান, এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে কীভাবে চাকুরি প্রত্যাশীগণ লাঞ্ছিত হয়েছেন তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ে পরীক্ষাকারী ডাক্তারদেরও যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণা ছিল না এবং যার ফলে ঢাকা সিভিল সার্জন রিপোর্টে এসেছে পরীক্ষাসম্পন্ন বারো জনের সকলেই পুরুষ এবং কেউ হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের কেউ নন। এমনকি প্রথম আলোর রিপোর্টে আরো এসেছে, জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজী ইন্সটিটিউটের তৎকালীন পরিচালক বলেছেন যাদের নারী ও পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে শুধু তারাই হারমোফ্রোরাইড বা হিজড়া।
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস এর পাকিস্তান ট্রান্সজেন্ডার পারসন্স (প্রোটেকশন অভ রাইটস) এক্ট, ২০১৮ এর রিপোর্টে উভলিঙ্গ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। উভলিঙ্গ বলতে নারী ও পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারীকে বোঝালেও হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার বলতে, যে সকল ব্যক্তি জন্মের সময় স্বাভাবিক পুরুষ বা নারীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মালেও পরবর্তীতে ছেদন, খোজাকরণ বা ক্রোমসোমের ভিন্নতার কারণে স্বাভাবিক যৌনজীবনযাপনে অক্ষমতার কারণে নিজেদের পুরুষ বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য লিঙ্গের হিসেবে মনে করা ব্যক্তিদের বোঝায়। এক্ষেত্রে অনেকে ট্রান্সজেন্ডার সমস্যাকে মানসিক সমস্যা হিসেবে মনে করলেও ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের ইন্টারন্যাশন্যাল ক্লাসিফিকেশন অভ ডিজিজেস (আই সি ডি ১১) মানসিক সমস্যার অধ্যায় থেকে লিঙ্গ নির্ধারণজনিত সমস্যাকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলতে ডাক্তারি পরিভাষায় যে ধারণা রয়েছে তা অপ্রতুল এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই ভুল ধারণার ফলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক এবং আইনী অধিকার অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। আর এর ফলেই, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের চাকরির মেডিক্যাল পরীক্ষায় লাঞ্ছিত হবার পরেও প্রতিকার পাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার সংরক্ষণে আধুনিক আইনবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রচলন না হলে, এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক বিধানসমূহ পরিবর্তন না করা হলে, প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে এদের অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।
তথ্যসুত্রঃ
১. http://yogyakartaprinciples.org/wpcontent/uploads/2016/08/principles_en.pdf
২. https://www.hrw.org/bn/report/2016/12/23/298051
৫. https://icd.who.int/browse11/l-m/en#/http%3a%2f%2fid.who.int%2ficd%2fentity%2f411470068
৬. নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১
Discussion about this post