মাজহারুল ইসলাম*
বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থা বা ডিসপিউট সেটেলমেন্ট বডির (ডিএসবি) অনন্যতা বা স্বাতন্ত্র্যতাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নিজেকে সর্বোপরি বাণিজ্য আইনকে একটি নির্দিষ্ট বা আলাদা পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য শাখা থেকে আলাদা করে রেখেছে: ক) ডিএসবির বাধ্যতামূলক কার্যক্ষমতা রয়েছে; খ) প্যানেল বা আপিলেট বডির পরামর্শ প্রায়শই বাস্তবায়ন হয়ে থাকে; গ) বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় আপিল কার্যক্রম বিদ্যমান। আর এ কারণেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা বাণিজ্য আইন আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য শাখার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
‘লেক্স ইস্পেসালিস’ নীতি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট আইন সাধারণ আইনের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে, যখন অনুরূপ বিষয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।যদিও আন্তর্জাতিক আইন কমিশন ২০০২ সালে ‘আন্তর্জাতিক আইন বিচ্ছেদ’ শিরোনাম প্রতিবেদনে মতামত প্রদান করেন যে, কোন আইনই আন্তর্জাতিক আইন থেকে আলাদা হতে পারে না।
যখন আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পর্কের কথা বলি, তখন আমাদের দেখতে হবে যে বাণিজ্য আইন আন্তর্জাতিক আইনের একটি শাখা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একটি সাংবিধানিক চুক্তি, স্থায়ী অঙ্গ, নিজস্ব তহবিল, স্থায়ী সদস্য পদ রয়েছে এবং তা নিজস্ব নাম ও নীতিমালার অধীনে কাজ করতে পারে। এ সকল বৈশিষ্ট্যগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার শর্ত পূরণ করে, আর আন্তর্জাতিক সংস্থা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনেরই সৃষ্টি। অতএব বাণিজ্য আইন বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যক্রম ও নীতিমালাকে আন্তর্জাতিক আইন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না, উপরন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন গুলির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে চলে।
এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান মামলা হচ্ছে কোরিয়া প্রকিউরমেন্ট, এতে প্যানেল মতামত প্রদান করে যে ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি তৈরিতে এবং চুক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে আন্তর্জাতিক প্রথাগত নিয়ম প্রযোজ্য’। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আন্তর্জাতিক প্রথাগত নিয়ম সর্বদাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার কিছু চুক্তিতে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবহার লক্ষণীয়। ট্রিপস চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক কনভেনশন, প্যারিস কনভেনশন, বার্ন কনভেনশন এবং রোম কনভেনশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু ট্রিপস এর ২(২) অনুযায়ী, ট্রিপস এর অনুচ্ছেদ গুলি এমন ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, যাতে করে ট্রিপসের বর্ণিত অন্যান্য চুক্তির সাথে মতানৈক্য সৃষ্টি না করে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার অনেক চুক্তিতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সমন্বয় সাধনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিএসবির প্রথমাংশে আন্তর্জাতিক আইন এর ব্যবহারের প্রসঙ্গটি বিদ্যমান। অনুচ্ছেদ ৩(২) ডিএসইউ অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থা বা ডিএসবি, কোন ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবহার করবে।এ থেকে বুঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবহার বিদ্যমান।
ইউ এস গ্যাসোলিন মামলায়, আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইন ব্যতীত বাণিজ্য চুক্তির ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে প্রদান সম্ভব নয়। ইউ এস শ্রিম্প মামলায়, আপিল বিভাগের বর্ণনা অনুযায়ী ‘একটি চুক্তি সাধারন অর্থ দ্বারা যদি ব্যাখ্যা সংগতিপূর্ণ না হয় সে ক্ষেত্রে প্যানেলকে ভিসিএলটি ১৯৬৯ এর মাধ্যমে চুক্তির উদ্দেশ্য ও মর্মের দিকে নজর দিতে হবে’।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা তার অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী ইংরেজি, ফ্রান্স ও স্পেনিশ ভাষাকে নির্ভরযোগ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ফলস্বরূপ কোন ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া হবে এমন দ্বন্দ্বের নিরসন আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। অনুচ্ছেদ ৩৩ ভিসিএলটি অনুসারে যে ক্ষেত্রে একটি চুক্তিতে একাধিক ভাষার বৈধতা পায় সে ক্ষেত্রে চুক্তির প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি ভাষাগত সংস্করণে অনুমিত হবে।
যদিও আর্জেন্টিনা ফুটওয়্যার ও ইন্ডিয়া কোয়ান্টিটেটিভ রেসটিকসন মামলায়, আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি সমূহের ব্যাখ্যাকে সংকোচন করার মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক আইন ও বাণিজ্য আইনের মধ্যে ভারসম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। উপরন্তু শ্রিম্প ডলফিন মামলা, অনুযায়ী আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক আইন ও বাণিজ্য আইনের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা রাষ্ট্রসমূহের নিকট বাণিজ্য প্রসারের একটি অন্যতম মাধ্যম, অতএব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনেই।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন সর্বদায় আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সু-সম্পর্ক বিধান করে চলে, যদিও একই সময়ে এর স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক আইন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি সমূহের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে বাণিজ্য আইনের শূন্যস্থান পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
অতএব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা বাণিজ্য আইন ও আন্তর্জাতিক আইন পারস্পারিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত।একইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি সমূহ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বা স্বাতন্ত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পরিবেশ আইনের মতো, কিন্তু কোন ক্রমেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা বা বাণিজ্য আইন আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে নয়।
*পিএইচডি গবেষণারত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারত। ইমেইল: talukderlaw@gmail.com
Discussion about this post