মো. রাইসুল ইসলাম সৌরভ<>ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মানুষের ব্যক্তি মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। গোপনীয়তার অধিকার নাগরিকের অন্যতম অধিকার এবং তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত। গোপনীয়তার অধিকারের সঙ্গে সংগঠন করার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো অন্য মৌলিক মানবাধিকারগুলোও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এককথায় গোপনীয়তার অধিকার হলো অবিচ্ছেদ্য এবং সর্বজনীন একটি মানবাধিকার, যা মানুষ তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সহজাতভাবে অর্জন করে। তাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মানুষের জীবন ধারণের অধিকারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি প্রখ্যাত সৌন্দর্যচর্চা (Beauty parlour) কেন্দ্রের স্পা সেন্টারে গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ভিডিওচিত্র ধারণের বিষয়টি প্রকাশ পেলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার যত্রতত্র ব্যবহার নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছাড়াও ইদানীং বর্তমান উঠতি প্রজন্মের ভেতর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই মুঠোফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে অনাকাঙ্ক্ষিত, স্পর্শকাতর বা বিব্রতকর মুহূর্তের চিত্র ধারণের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহকরা কেবল চিত্রগ্রহণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, অধিকন্তু কখনো কখনো ধারণ করা স্থির অথবা চলচ্চিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে বা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। কখনো কখনো আবার সরলতার সুযোগ নিয়ে, প্রতারণা বা জোর করে কারো গোপন মুহূর্ত ধারণ করে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এসবের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে অহরহ।
বাংলাদেশে সিসি টিভির ব্যবহার বা নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা প্রদান বিষয়ে আলাদা কোনো নীতিমাল বা আইন নেই। তাই এ দেশে সিসি টিভির ব্যবহারে কোনোরূপ নিয়মনীতি বা নূ্যনতম নৈতিকতার বালাই পরিলক্ষিত হয় না। অথচ বিশ্বের সর্বত্রই সিসি টিভির ব্যবহারের কিছু স্বীকৃত নিয়ম-কানুন আছে। তার পরও যে সেসব দেশে সিসি টিভির মাধ্যমে মাঝেমধ্যে গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয় না তা নয়, কিন্তু কালেভদ্রে সেসব বিষয় জনসম্মুখে প্রকাশ পেলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে তবেই রেহাই পাওয়া যায়। অথচ আমাদের দেশে যেখানে আইনই নেই, সেখানে আইনি প্রতিকার পাওয়া তো পরাবাস্তব এক স্বপ্নের নাম। যেসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান আছে, সেসব ক্ষেত্রে অধিকার লঙ্ঘিত হলে যেখানে এ দেশে আইনি প্রতিকার পাওয়া যায় না, সেখানে নীতিমালার অনুপস্থিতিতেই সুরক্ষা পাওয়া তো অনেক দূরের পথ! তা ছাড়া আমাদের দেশে সামাজিক মর্যাদা ও আইনি ঝামেলা থেকে দূরে থাকার মানসিকতার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ব্যাপারে আইনি সুরক্ষা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
নিরাপত্তার ধুয়া তুলে যেখানে-সেখানে সিসি টিভি লাগালেই স্থাপনকারীর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং নিয়ম হলো কারো চিত্র ধারণ করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে যথাযথভাবে অনুমতি নিয়ে নেওয়া এবং ছবিটি কী কাজে ব্যবহৃত হবে, তা তাকে বুঝিয়ে বলা। তবে প্রতারণার মাধ্যমে বা ভুল বুঝিয়ে কারো সম্মতি নিলেও আইনগতভাবে সে সম্মতির কোনো দাম নেই। কোনো জায়গায় সিসি টিভি কার্যকর থাকলে সেখানে অবশ্যই দৃশ্যমান স্থানে এবং স্পষ্ট ভাষায় লিখিত নোটিশের মাধ্যমে আগন্তুকদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে হবে। অন্যথা স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যেখানে স্বাভাবিকভাবেই গোপনীয়তা বজায় রাখার কথা (যেমন_টয়লেট, গোসলখানা, পোশাক পরিবর্তনের স্থান, চিকিৎসা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে, যেখানে গোপনীয়তা বজায় রাখা আবশ্যক ইত্যাদি), সেখানে কোনো অবস্থায়ই এ ধরনের কোনো গোপন ক্যামেরা চালানো যাবে না। তা ছাড়া ক্যামেরাটি কোথায় লাগানো এবং কত সময়ব্যাপী ভিডিও ধারণ করা হবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করতে হবে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কারো আপত্তিকর কোনো চিত্র বা ভিডিও ধারণ করা হলে তার বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনানুযায়ী (ধারা ৫৭ ও ৬৭) ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
সিসি টিভিতে ধারণ করা কোনো ছবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দেখতে চাইলে তাকে তৎক্ষণাৎ তা বিনা কর্তনে (censor) দেখার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং সেই ধারণ করা চিত্র সম্পর্কে কোনো আপত্তি জানালে তা স্থায়ীরূপে মুছে ফেলার এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ভিডিওর মাস্টারকপি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোক্রমেই বাণিজ্যিক বা অসৎ উদ্দেশ্যে ওই ভিডিওচিত্র ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে ওই ভিডিওচিত্র অন্য কোথাও ব্যবহার করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। যদিও সরকার চাইলে নিরাপত্তাজনিত কারণে কিংবা জনস্বার্থে এ ধরনের ভিডিওচিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রেও নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত এবং যথাযথভাবে কারণ দর্শানো উচিত। এ ছাড়া সরকারিভাবে কোনো স্থানের চিত্র বা ভিডিও ধারণ করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হলে তা প্রকাশ করা উচিত। এমনকি রাস্তা বা প্রকাশ্য কোনো স্থানের ক্ষেত্রে এ রকম কিছু করতে চাইলে যথাযথ চিহ্ন বা নোটিশের দ্বারা ক্যামেরার উপস্থিতি জানিয়ে দেওয়া উচিত। কোনো নাগরিকের পূর্বানুমতি ব্যতীত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক চিত্র ধারণ বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করাও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ১২ অনুচ্ছেদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদের ১৭ অনুচ্ছেদসহ (বাংলাদেশ যাতে স্বাক্ষর করে পক্ষভুক্ত হয়েছে) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও ১১ অনুচ্ছেদে ‘ব্যক্তির মর্যাদা’ এবং ৪৩ অনুচ্ছেদে ‘গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ’ নামে বৃহদার্থে বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৭৮ এবং ৭৯ নম্বর ধারায় নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
তবে আইনটি এখনো পর্যন্ত যথাযথভাবে প্রয়োগ হয়নি। কারণ প্রযুক্তিবিষয়ক এ আইনটি অন্য আর আট-দশটি আইনের মতো সাধারণ কোনো আইন নয়। ফলে আমাদের সাধারণ জনগণ, পুলিশ, আইনজীবী, এমনকি বিচারকরাও আইনটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত প্রযুক্তির অনেক জটিল বিষয়ের সঙ্গেই পরিচিত নয়। তা ছাড়া আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির অনেক কিছুই গৎ বাঁধা আইনি কাঠামো দিয়ে বিচার করা সম্ভব নয়। আবার তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়গুলো যেহেতু কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলে না, তাই এ ক্ষেত্রে বিচারিক অধিক্ষেত্র নিয়ম নিয়েও জটিলতার শেষ নেই। প্রযুক্তির নিত্যনতুন কলাকৌশল ও যন্ত্রের সঙ্গে তাই আমাদের আইন পাল্লা দিয়ে পারছে না। ফলস্বরূপ এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। সামাজিক ও আইনগত এসব জটিলতার কারণে কখনো কখনো সমাজের উচ্চবিত্ত ও প্রভাবশালী তারকারাও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হয়ে বিচার বঞ্চিত থেকে যান।
এই যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়গুলো ছাড়াও কিছু বিশ্বাসের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখা আবশ্যক, যেমন_ডাক্তার-রোগী, আইনজীবী-মক্কেল, ছাত্র-শিক্ষক ইত্যাদি আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গোপন বিষয়াবলি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে এবং তা কোনোক্রমেই অনুমতি ব্যতীত অন্যের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না।
এবার চোখ ফেরানো যাক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দিকে। রাষ্ট্র প্রায়ই নানা অসিলায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে। কখনো আবার সেই অবৈধ কাজটিকে বৈধতার আবরণে আচ্ছাদিত করতে আইনসভা থেকে আইন পর্যন্ত পাস করে ফেলে। এমনই একটি আইনের নাম হলো_২০০৬ সালের সংশোধিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন। ২০০২ সালের পুরনো আইনের ৯৭ ধারার সঙ্গে নতুন আইনে ৯৭ক ধারা যোগ করা হয়। ফলে এখন থেকে সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার(?) স্বার্থে যেকোনো নাগরিকের টেলিফোন আলাপে আড়ি পাততে পারবে বা কথোপকথনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে! অথচ নাগরিকের কণ্ঠ কিভাবে শনাক্ত করা হবে সে ব্যাপারে এই আইন নীরব। আবার ৯৭খ ধারানুযায়ী এ ধরনের তথ্য ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনানুযায়ী সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে কেবল নির্বাহী আদেশে, এ জন্য কোনো বিচারিক আদেশ লাগবে না, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের চরম লঙ্ঘন।
আমাদের সংবিধানসহ অন্যান্য আইনে নাগরিক অধিকারগুলো খুব সুন্দর ভাষায় উপস্থাপন করা হলেও অধিকার উপভোগের সীমা বিবিধ অজুহাতে অনেক সংকীর্ণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা তেমনি এক অজুহাতের আইনি নাম। অথচ আইনে উল্লেখ থাকলেও কখনোই ভিন্ন কোনো আইন বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিকার সীমাবদ্ধ করার পথ বাতলে দেওয়া হয় না বা কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় না যে ঠিক কিভাবে ওই নাগরিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল?
আর আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তো কোনো নিয়মের পরোয়া না করেই যখন-তখন (এমনকি গভীর রাতেও) যে কারো বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগত নিরাপদ আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করা তো নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। নূ্যনতম অনুমতি অথবা ভদ্রতা দেখানোরও প্রয়োজন অনুভব করে না। উল্টো কখনো তা ভাঙচুর ও সম্পদহানি পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এ ধরনের অনধিকার চর্চা সংবিধান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।
Discussion about this post