বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি :: সংস্কৃতির ধারক বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ এখন বহিরাগত ক্যাডারদের অভয়ারণ্য। অবকাঠামোর দিক দিয়ে প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সুস্থধারার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতি লক্ষনীয়। বিগত কয়েক বছর থেকে নানা অনৈতিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক সংঘাত, দলীয় কোন্দল, ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনার পুণরাবৃত্তির ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
অবদান রাখার জন্য ডিগ্রী কলেজ থেকে উন্নিত করে অনার্স কোর্স চালু করা হয় শিক্ষার উন্নিতর জন্য। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিদ্যাপিঠে শিক্ষা সংবাদের চেয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকার সংবাদের খোরাক হচ্ছে অহরহ। এই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যেন পিছু ছাড়ছে না।
দিনের পর দিন এসব সন্ত্রাসী ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এসব ঘটনাগুলো অপ্রীতিকর। যারা এই শিক্ষা
প্রদান করেন তাদেরকে জাতি গড়ার মূল কারিগর বলা হয়ে থাকে। তাদের স্থান পিতা-মাতার পরেই । সম্প্রীতি বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজে কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা
ও শিক্ষক লঞ্ছনার ঘটনা পর্যালোচনা করলে পরিলক্ষিত হবে
যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান দিচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজে শিক্ষার
পরিবেশকে কুলষিত করছে গুটিকয়েক ছাত্র/ছাত্রী
নামধারী শিক্ষার্থী। অনুসন্ধানে দেখা যায়, অধিকাংশ
ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গণে বহিরাগত শিক্ষার্থীরাই এ সমস্ত
অনৈতিক অশ¬ীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। গত কয়েক
বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে কয়েকটি অপ্রীতিকর ও
অনাকাংখিত ঘটনা সূত্রপাত ঘটে তার বেশিরভাগই সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন ও ইভটিজিংকে কেন্দ্র
করে। পরবর্তীতে এসমস্ত ব্যক্তিগত অনৈতিক কার্যকলাপ বা
উচ্ছৃঙ্খলতার প্রভাব রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হয়।
বহিরাগতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের
ছত্রছায়ায় এ সমস্ত ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বলে সাধারণ
শিক্ষার্থীরা জানান।
চলতি বৎসরের জানুয়ারী থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যৌনহয়রাণী, ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে
অননৈতিক আচরণ, শিষ্ঠাচার বহির্ভূত কর্মকান্ড ও শিক্ষক লাঞ্ছনার
মতো ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২০টিরও অধিক। গত ২৩ আগষ্ট
কলেজে ক্লাস চলাকালীন বাহিরে বসে অকথ্য এবং অযথা
কথা বলায় বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রশান্ত মৃধা
মোস্তাক আহমদ নামের এক ছেলেকে স্থান ত্যাগের
নির্দেশ দেন। কথিত ওই ছাত্র শিক্ষকের আদেশ অমান্য
করে উল্টো শিক্ষককেই বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধামকি প্রদান
করে। হুমকি-ধামকির এক পর্যায়ে সে তার নিয়ন্ত্রিত কর্মী
বাহিনীকে নিয়ে ওই শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে।
পরবর্তীতে কলেজের অধ্যক্ষ বিষয়টি আঁচ করতে
পারলে শিক্ষককে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন। এর
কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিয়ানীবাজার
সরকারী কলেজ ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবন তালাবদ্ধ করে,
এবং জুন মাসে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায়
নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত মাহমুদের বিচারের লক্ষ্যে
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং করে। প্রশ্ন উঠেছে,
শিক্ষাঙ্গন কি কথিত রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বাহিনীর নিকট
জিম্মি ? এক পর্যায়ে কলেজের শিক্ষকদের ধারাবাহিক
বোর্ড মিটিংয়ে রেজিষ্টারী খাতা চেকআপ করে কথিত ওই
শিক্ষার্থীর নাম খুঁজে পায়নি শিক্ষকরা।
প্রশ্ন উঠে তাহলে কে এই মোস্তাক? শিক্ষক
শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বর্তমানে
প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনে অন্তর্দন্দ্বের ফলে ছয়টিরও
অধিক গ্র“পে বিভক্ত। যার ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট
আকার ধারণ করছে। এরই সুযোগে বিভিন্ন সময়ে অশালীন,
অনৈতিক ও অরাজনৈতিক এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য
বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ এসব ছাত্রসংগঠনে।রাজনীতি
সচেতনদের ধারনা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম
স্থিমিত হয়ে যাওয়ায় এবং গত এক যুগেরও অধিক সময় থেকে
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুস্থ
ধারার রাজনৈতিক চর্চার অভাব লক্ষণীয়ভাবে দেখা দিচ্ছে। যার
ফলে শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে
অভিযুক্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী
ছাত্র শিবিরের কর্মকান্ড বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজে
নেই বললে চলে। হামলা-মামলার ভয়ে পালিয়ে ও বিভিন্ন
সময়ে গাঁ ঢাকা দিয়ে গোপণে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে ছাত্র সংগঠনের এরকম এহেন কর্মকাণ্ডে
অসন্তোষ প্রকাশ করে অনার্স বাংলা বিভাগের ১ম বর্ষের
ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
শুধু এই ছাত্রী নয় আরো অনেকে এই প্রতিবেধক বলেন, আমরা পড়তে এসেছি, এখানে মারামারি
দেখতে আসিনি।
কর্তৃপক্ষের উচিত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে
এসে এদের সঠিক বিচার করা। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের
বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ
জসিম উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করা।
ব্যক্তিগত বা আঞ্চলিক সমস্যাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা
উচিত নয় এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট থেকে উত্তরণের
লক্ষ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও সুস্থ ছাত্র রাজনীতির চর্চা করা
জরুরী। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিয়ানীবাজার
উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কাশেম
বলেন, ‘এ সমস্ত কর্মকান্ডের জন্য স্থানীয়
আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতাই প্রমাণ করে।
তারা যদি তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে সঠিকভাবে
পরিচারনা করত তাহলে শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনার বারবার
পুণরাবৃত্তি হতো না।’
বোদ্ধা মহল মনে করেন, “বিয়ানীবাজারের অতীতে
অনেক সুনাম ছিল। এখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন
প্রমথ নাথ দাস, ড. জি.সি দেব, মৌলানা হাছন আলী, মৌলানা আতর
আলী, মুফতী মৌলানা সফর উদ্দিন, আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম,
ইরফান আলীসহ শেষতক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ।
কিন্তু বর্তমানে সময়ে শিক্ষাঙ্গণের পরিবেশ দিন দিন নষ্ট
হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কোনমতে
এসএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষা শেষ করলেই
হাফ ছেড়ে বাঁচে। এরপর সরকারী কলেজে ভর্তি হলেও
ঠিকমতো শিক্ষার্থীদের দেখভাল করছেন না তাদের
অভিভাবক। ফলে কলেজে এসে তারা লেজুড় ভিত্তিক ছাত্র
সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে দলাদলি,
মারামারি, হানাহানির সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের মতো একটি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে বখাটেরা এত সহজেই অপরাধ সংগঠিত করতে
পারে ভেবে বিস্মিত এঅঞ্চলের শিক্ষা সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিরা।
কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিকুল
ইসলাম উদ্বুত পরিস্থিতির জন্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি
অভিভাবকদের অভিযোগ করে বলেন, ‘তারা তাদের
সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হলে কলেজের পরিস্থিতি
এরকম হতো না। শিক্ষার্থীরা কলেজের নাম করে
বাজারের বিভিন্ন শপিং মল, রেস্তোরা ও বিভিন্ন জায়গায়
ঘুরাফেরা করে। এমনকি তারা কলেজের নির্ধারিত পোশাক
ছাড়াও ক্যাম্পাসে চলাফেরা করে।’ অভিভাবকদের উচিত
সন্তানদের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হওয়া।”
বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের পরিচালনা পর্ষদের
সভাপতি প্রবীণ শিক্ষক আলী আহমদ বলেন, ‘কলেজ
চলাকালীন সময়ে কোনো ধরনের গ্রুপিং কিংবা কলেজ
কার্ড ব্যতীত কাউকে ভিতরে ঢুকতে না দেয়া। বাবু প্রমথ
নাথ দাসের হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠানটিকে হাটি হাটি পা পা করে
আজ অনার্স কলেজ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।
আমরা আশা করি প্রতিষ্ঠানটি তার অতীত ঐতিহ্য বজায় রাখতে
সচেষ্ট হবে।” বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির
সহ সভাপতি মজির উদ্দিন আনসার বলেন, ‘১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত
হওয়া এ কলেজটি ’৮৭ ইংরেজি সনে সরকারীকরণ হয়।
পরবর্তীতে বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম
নাহিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে কলেজটি অনার্স
কলেজ হিসেবে পরিচিত। অনার্স কলেজ হওয়াতে এই
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা ক্লাস করাবেন আমরা
তাদের যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করব।’ বিয়ানীবাজার
সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ
বলেন, শিক্ষক প্রশান্ত মৃধাকে লাঞ্ছিতের পর তাৎক্ষণাত
কলেজ প্রশাসন বোর্ড মিটিংয়ে বসে এবং প্রশাসনকে
অবহিত করি। মন্ত্রী কলেজের ডরমিটরির উদ্বোধনকালে
তাকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত মোস্তাককে
আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আলাপকরলে তিনি জানান,
বিষয়টি থানা অফিসার ইনচার্জ দেখছেন।
Discussion about this post