দেশে চলমান সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ ও তার অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা নিয়ে সবসময় আলোচনা সমালোচনা বিদ্যমান রয়েছে। জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বর্তমান সরকার এই অনিয়ন্ত্রিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রচেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি করে। যদিও ১৯৯০সাল থেকেই দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর ছিলো। কিন্তু, পুরাতন আইনটি চলমান পরিস্থিতির সাথে বড্ড বেমানান হয়ে পড়েছিল। তাই, ১৯৯০ সালের আইনকে প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন আইনটি চালু হয়। নতুন আইনটি অত্যন্ত এবং যুগোপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। সমসাময়িক আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হতে পারে এমন কোন সংজ্ঞা, উপাদান ও আলোচনা নেই যা এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পূর্বের আইনে সীসা বা ইয়াবা মাদকের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নতুন আইনে সেটাকে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বের আইনের ২০টি সংজ্ঞার পরিবর্তে বর্তমান আইনের ধারা ২ এ ৩৬টি সংজ্ঞা বিদ্যমান রয়েছে।
★ট্রাইব্যুনাল শূন্যতা এবং মোবাইল কোর্ট
দেশে প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজারের অধিক মাদকসংক্রান্ত মামলা চলমান থাকলেও, নেই কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ধারা ৪৪ অনুযায়ী আইনের অধীন একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকলেও বিচারক স্বল্পতায় এখন পর্যন্ত কোন স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় নি। তবে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও, সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মাদকের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য জেলা ও মহানগর জজদের দায়িত্ব দেয়ার বিধান রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ৪৪(৪) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, এ ধারার অধীন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংশ্লিষ্ট জেলার যেকোনো অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে তাহার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে।
ধারা ৫৭তে আইন না পড়া এবং কম জানা মোবাইল কোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের এই আইনের অধীন বিচার করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যারা ইতিমধ্যেই মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া সাজা প্রদান করার জন্য সমালোচিত হয়েছে। এবং ৭ বছরের কম কারাদন্ডের ক্ষেত্রে ধারা ৪৮এ মামলার বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে নিষ্পন্ন হওয়ার বিধানও রাখা হয়।
★আইনের কতিপয় বিধানাবলী
১৯৯০ সালের আইনের ধারা ৮ অনুযায়ী বাংলাদেশে একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেটি বর্তমান আইনের ৪ নং ধারায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সরকার কর্তৃক (৭ ধারানুযায়ী) নিয়োগপ্রাপ্ত একজন মহাপরিচালক যেটার দায়িত্বে রয়েছেন। এবং ৫ ধারানুযায়ী অধিদপ্তরটি মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত ৮ ধরনের কার্যক্রম সম্পাদন করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
আইনটির ধারা ২(২৯) অনুসারে ১ম তফসিলে মাদকদ্রব্যকে ৩টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে।
যেখানে, ‘ক’ শ্রেণিতে অপিয়াম পপি গাছ, ইয়াবা, কোকেন, আফিম এবং হেরোইনসহ ২০০ এর অধিক মাদকদ্রব্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘খ’ শ্রেণিতে গাঁজা, ভাং, সিদ্ধি, ওয়াইন, বিয়ার, মদ এবং ০.৫% এর অধিক অ্যালকোহলযুক্ত দ্রব্যসহ প্রায় ১০০টি দ্রব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবং ‘গ’ শ্রেণিতে তাঁড়ি পঁচুইসহ ৫০এর অধিক দ্রব্যের উল্লেখ রয়েছে।
অন্যদিকে ৫৮ ধারানুসারে তফসিল-২ এ ৮ ধরণের দ্রব্যের উপর মাদকশুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ধারা ৫৬ তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা তদন্তকারী সংস্থার কোনো সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো মাদকদ্রব্য অপরাধ বা ক্ষতি সংঘটন বা সংঘটনের প্রস্তুতি গ্রহণ বা উহা সংঘটনে সহায়তা সংক্রান্ত কোনো ঘটনার ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ বা গ্রহণ করিলে বা কোনো কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা টেপ রেকর্ড বা ডিস্কে ধারণ করিলে উক্ত ভিডিও, স্থিরচিত্র, টেপ বা ডিস্ক উক্ত অপরাধ বা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মামলা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে।
১৯৯০ সালের আইনে কেউ ২৫ গ্রামের অধিক নিষিদ্ধ ‘এ শ্রেণীর মাদক হেরোইন, পেথেডিন, মরপিন, কোকেনসহ আরও কতিপয় মাদকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল, বর্তমান আইনে নতুন করে ৫ গ্রামের অধিক নিষিদ্ধ ইয়াবা কেনাবেচায় মৃত্যুদন্ডের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনটির ধারা ৬১ তে মাদকসেবীদের শুধুমাত্র শাস্তিই নয়, তাদের জন্য পুনর্বাসন ও নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করার কথাও বলা হয়েছে।
আইনটির ধারা ৩৬ (১)এ ধারা ৯ এবং ১০ এর বিধান লঙ্ঘনের শাস্তি উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি নিম্নের সারণির ২য় কলামে উল্লিখিত কোনো মাদকদ্রব্য সম্পর্কে ধারা ৯ এবং ১০ এর কোনো বিধান লঙ্ঘন করে তাহা হইলে তিনি উক্ত সারণির কলাম ৩ এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন, যথা- (২) কোনো মাদকদ্রব্য অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া দণ্ড ভোগ করিবার পর যদি কোনো ব্যক্তি পুনরায় কোনো মাদকদ্রব্য অপরাধ করেন, তাহা হইলে উক্ত অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না হইলে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য এই আইনে সর্বোচ্চ যে দণ্ড রহিয়াছে উহার দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। (৩) কোনো ব্যক্তি অ্যালকোহল পান কিংবা যে-কোনো ধরনের নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জনসাধারণের শান্তি বিনষ্ট অথবা বিরক্তিকর কোন আচরণ করিলে কিংবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালনা করিলে তিনি অনূর্ধ্ব ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে। (৪) কোনো সরকারি যানবাহনের চালক যানবাহন ব্যবহারকারী অফিসারের অনুপস্থিতিতে গাড়িতে মাদকদ্রব্য পরিবহণের সময় যদি ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক হাতেনাতে আটক হন, তাহা হইলে তাহার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অপরাধ অনুযায়ী আইনানুগ এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।
আইনটির ৫ম অধ্যায়ে অপরাধ ও দণ্ড বিভাগে নতুন সংযোজন হিসাবে যারা মাদক ব্যবসায় অর্থ যোগানদাতা, পৃষ্টপোষকতা, মদদদাতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিধান রাখা হয়েছে যা উক্ত আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি কোন মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ করিলে অথবা অর্থ সরবরাহ করিলে অথবা সহযোগিতা প্রদান করিলে অথবা পৃষ্ঠপোষকতা করিলে তিনি সংশ্লিষ্ট ধারায় নির্ধারিত দণ্ডের অনুরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এবং ৫২ ধারা নতুন সংযোজন হিসাবে শিশু মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলে তাহার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শিশুর বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে ৷ কোনো শিশু মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলে তাহার ক্ষেত্রে শিশু আইন, ২০১৩ এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হইবে ৷
★ট্রাইব্যুনাল গঠন না করার যৌক্তিকতা
অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং নতুনভাবে সৃষ্ট মাদকের আগ্রাসন রোধে ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তে বিশেষ আদালত গঠন করে মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। আগে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করার কথা ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক কারণে সেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এখন এক লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। মাদকের জন্য এখতিয়ারসম্পন্ন বিশেষ আদালত গঠন করছি। যেখানে ছয় মাসের কারাদণ্ড আছে, মৃত্যুদণ্ডও আছে। যে আদালতের যতটুকু ক্ষমতা সে আদালত ততটুকু বিচার করবেন। ক্ষমতাটুকু জেলা জজের কাছে দিয়ে দিচ্ছি, তিনি তার প্রয়োজন অনুযায়ী আদালত গঠন করে দেবেন। ‘শুধু মাদকের জন্য জেলা ও দায়রা জজ কোর্টগুলোকে ডেডিকেটেড করে দেবেন। স্পেশাল এখতিয়ার সম্পন্ন স্পেশাল আলাদত, প্রত্যেক জেলা ও মহানগরে। ট্রাইব্যুনাল থেকে জনস্বার্থে সরকার সরে আসছে। প্রশাসনিক জটিলতা কী- ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য যে পরিমাণ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রয়োজন তার কিছুটা সঙ্কট ছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল মাদকের মামলাগুলোকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অপরাধীকে ধরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ছয় মাসের জেল হবে সেটাও একজন জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বিচারে যাচ্ছে। যেখানে হত্যা মামলার মতো মামলাগুলো হ্যাম্পারড হতে পারে। কারও ছয় মাসের জেল হলো, জরিমানা হলো, সঙ্গে সঙ্গে তার আপিলের অথরিটি হাইকোর্ট। পঞ্চগড় বা টেকনাফের আসামিকে জেল দিয়ে আপিল করতে তাকে ঢাকা আসতে হবে। এসব প্রশাসনিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে সরকার চিন্তা করেছে যদি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করা হয় তবে যে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিপক্ষে জজকোর্টে আপিল করতে পারছে।
Discussion about this post